কাঠমিস্ত্রি আব্দুর রশিদ। মাতৃভূমি রক্ষায় জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার পর সহযোদ্ধা শহীদ আবু খার মা টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ায় অভিমান করেই স্বীকৃতি চাননি আব্দুর রশিদ। কিন্তু জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসে ভাতা নয়, মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান রণাঙ্গনের এই যোদ্ধা।
আব্দুর রশিদের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরের বাঘবেড় গ্রামে। তার বাবা মৃত হাফিজ উদ্দিন। মা মৃত শহরের নেছা। পেশায় কাঠমিস্ত্রি হলেও গ্রামবাসী তাকে একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানপ্রেমী হিসেবে চেনে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও এখনো প্রতিবছর ১৫ আগস্ট একা একা টুঙ্গিপাড়ায় যান বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করতে।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) সকালে বাঘবেড় গ্রামে গিয়ে কথা হয় আব্দুর রশিদের সঙ্গে। আলাপচারিতায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে রণাঙ্গনের নানা ঘটনা তুলে ধরেন এই প্রতিবেদকের কাছে।
আব্দুর রশিদ বলেন ‘১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহ শহরে আনসারের (সশস্ত্র) প্রশিক্ষণ নেই। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেয়ার পর আনসার শিবিরে গুঞ্জন শুরু হয় যেকোনো মুহূর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক আসতে পারে। তাই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। এরপর আমরা আনসাররা ময়মনসিংহে জড়ো হই। পাকবাহিনী ট্রেনযোগে ময়মনসিংহে যাতে না আসতে পারে সেজন্য জেলা আনসার অফিসার মালেক সাহেব আমাদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে প্রত্যেককে অস্ত্র ও গুলি দিয়ে কেওয়াটকালী এলাকায় রেলপথে পাহারায় পাঠান। কয়েকদিন পর সেখান থেকে আমরা ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে যাওয়ার পথে পাকবাহিনী বিমান হামলা করলে ছত্রভঙ্গ হয়ে অস্ত্র নিয়ে গৌরীপুর বাড়িতে আসি। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রশিক্ষণের জন্য নেত্রকোনার রংরা বর্ডার দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি।’
জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল হক তারার নেতৃত্বে নেত্রকোনার কলমাকান্দা, নাজিরপুর, বাইশদার, বড়াইল সহ বিভিন্ন এলাকা হানাদার মুক্ত করতে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন আব্দুর রশিদ।
কথা প্রসঙ্গে রশিদ বলেন, ‘স্বাধীনতার পর শহীদ আবু খার বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি টাকার অভাবে তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা হচ্ছে না। এরপর আমি বাড়ি এসে কিছু টাকা সংগ্রহ করি। কয়েকদিন পর টাকা নিয়ে ওই বাড়িতে যাই। কিন্তু আবু খার বোন কাঁদতে কাঁদতে কবর দেখিয়ে বলেন মা আর বেঁচে নেই। স্বাধীন দেশে শহীদের মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন সেই কষ্টে আর স্বীকৃতি চাইনি। এখন বয়স হয়েছে। তাই মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটা পেতে চাই। তবে আমার কোনো ভাতার দরকার নেই।’
নেত্রকোনা সদর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আইয়ুব আলী বলেন, ‘রশিদ ভাই আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। রশিদ ভাই একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তাকে যেন দ্রুত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় সে দাবি জানাচ্ছি। রশিদ ভাই যদি স্বীকৃতি না পান, তাহলে সহযোদ্ধা হিসেবে আমরা বিবেকের কাছে ঋণী থাকব।’