বিদ্যাসাগর-মধুসূদনের বন্ধুত্ব: অতলান্ত সাগরে অমৃতের সম্ভার

, শিল্প-সাহিত্য

মাফরুহা সিফাত | 2023-09-01 23:44:49

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।

করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,

দীন যে, দীনের বন্ধু !– উজ্জল জগতে

হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।

সুবন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে নিজের কবিতায় এমন মন্তব্যই করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। অথচ এই দুই বিপরীত মেরুর সাহিত্যিকের বন্ধুত্বের সূচনার অভিজ্ঞতা কিন্তু সুখকর ছিলো না। দুজনের কেউই কাউকে পছন্দ করতেন না তেমন।

মধুসূদন বিদ্যাসাগরকে আড়ালে ডাকতেন ‘টুলো পণ্ডিত’ বলে, আর মধুসূদনের ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দ নিয়ে বিদ্যাসাগরও ব্যঙ্গ করতে ছাড়তেন না। তাই তাঁর কাছে একেবারেই অসহনীয় এই ছন্দ নিয়ে তিনি ক্যারিকেচার করতেন: ‘তিলোত্তমা বলে ওহে শুন দেবরাজ,/তোমার সঙ্গেতে আমি কোথায় যাইব?’ তবে ‘টুলো পণ্ডিত’ বলে ব্যঙ্গ করলেও মাইকেল তাঁর বন্ধু ও ত্রাতা বিদ্যাসাগরের প্রতি ছিলেন পরম শ্রদ্ধাশীল।

‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ ও ‘পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ নামে দুটি কবিতায় তিনি অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে গেছেন। ধীরে ধীরে তাঁদের বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে প্রগাঢ়। এই ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কালোত্তীর্ণ মর্যাদায় আসীন।

দুজন দুজনকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে মেতে থাকলেও, বাংলা সাহিত্যে ও সমাজে দুজনেরই প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম হয়ে উঠেছিলো। বিশেষ করে বাংলা নাটকের পৃষ্ঠপোষকরা দুজনকেই সমানভাবে কদর করতেন। তাই ঠাকুরবাড়িতে থিয়েটারের জন্য ‘কার্যনির্বাহক সমিতি’ গঠিত হলে অনেকের সঙ্গে এই দুই প্রতিভাধর ব্যক্তিকেও সভ্য করা হয়। বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সময় পাইকপাড়ার রাজারা বিদ্যাসাগরকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। আবার তাঁরা ছিলেন সাহিত্যচর্চার দিক থেকে মাইকেলেরই প্রথম ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক।

তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছিলো আদি-মধ্য-অন্তবিশিষ্ট পদচারণা। অনেক প্রতিকূলতা, সংস্কার-আচ্ছন্নদের বাক্যবাণ ও সংকীর্ণতার দেয়াল ডিঙিয়ে বর্তমানে আমাদের সমাজ যতদূর এগিয়েছে, তার পেছনে বিদ্যাসাগরের অবদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ উপমহাদেশে তাঁর মতো আপাদমস্তক সমাজসংস্কারক প্রায় নেই বললেই চলে। বিদ্যাসাগরের অপার উদারনৈতিকতার সঙ্গে যাঁদের প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল তাঁদের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন অন্যতম।

মধুসূদন কবি হিসেবে সফল হলেও জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি অর্থকষ্টে ভুগেছেন। দেনার দায়ে তাঁর জেলে যাওয়া, ব্যারিস্টারি পড়া বন্ধেরও উপক্রম হয়েছিল। ওই দুর্দিনে তাঁকে আর্থিক ও মানসিকভাবে আগলে রেখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

বিদ্যাসাগরের সাথে মধুসূদন দত্তের পরিচয় হয় ১৮৫৬ সাল থেকে। তখনও তাঁদের সম্পর্ক গাঢ় হয়নি। পরবর্তীতে ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’কে ঘিরে তাঁদের সম্পর্কের বাঁক পরিবর্তন হতে শুরু করে। মধুসূদন এটা জেনে উৎফুল্ল হন যে, এই কাব্যে বিদ্যাসাগর ‘গ্রেট মেরিট’ খুঁজে পেয়েছেন। গবেষক বিনয় ঘোষের মতে, ওই বছরই মধুসূদন বিদ্যাসাগরের প্রস্তর মূর্তি স্থাপনের জন্যে বেতনের অর্ধেক টাকা দানের প্রস্তাব করেন। এ থেকে অনুধাবন করা যায়, খুব দ্রুতই তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

মধুসূদন দত্তের বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার অন্যতম সমর্থক ছিলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৬২ সালের ৯ জুন ব্যারিস্টারি পড়তে কবি বিলেত পাড়ি জমান। জমিজমা সংক্রান্ত জটিলতায় বিলেতে দিনযাপনের সময় ভারতবর্ষ থেকে তাঁর জন্য টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। ওইসময় মধুসূদন পাওনা টাকার জন্যে চিঠি লিখলেও উত্তর পেতেন না। ফলে তিনি সীমাহীন আর্থিক কষ্টে পতিত হন। অর্থ সাশ্রয়ের জন্যে ১৮৬৩ সালের মাঝামাঝিতে কবি লন্ডন থেকে প্রথমে প্যারিস এবং পরবর্তীতে ভার্সাইতে যান। এসময় দেনার দায়ে তাঁর ফ্রান্সের জেলে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তখন পর্যন্ত মধুসূদন বিদ্যাসাগরকে কোনো চিঠি লেখেননি। অভাব যখন তীব্রতর হলো এবং আর কোনো উপায় অবশিষ্ট রইল না, তখনই তীব্র আকুতি ও নিজের দুর্দশা জানিয়ে কবি বিদ্যাসাগরকে পত্র লিখলেন। চিঠি পেয়ে ঐ দুঃসময়ে তাঁর পাশে দাঁড়ান বিদ্যাসাগর।

১৮৬৪ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে পাঠানো ২১টি চিঠিতে মধুসূদন তাঁর দুরাবস্থার কথা জানান। মধুসূদন জানতেন বিদ্যাসাগর তাকে নিরাশ করবেন না। বিদ্যাসাগরের অন্যতম জীবনীকার বিহারিলাল সরকার জানিয়েছেন, মধুসূদনের চিঠি পাঠ করে বিদ্যাসাগর কেবল অর্থসাহায্যই পাঠাতেন না, তাঁর চিঠির ভাষায় বিদ্যাসাগর ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়তেন এবং কখনও কখনও কাঁদতেনও। অনেক সময় কবি টাকা চেয়ে চিঠি লিখলেও বিদ্যাসাগরের হাতে টাকা থাকতো না। তিনি তখন ঋণ করে হলেও মধুসূদনকে টাকা পাঠাতেন। মধুসূদনও জানতেন তার কারণে বিদ্যাসাগর বিপদে আছেন।

বিদেশে অভাব-অনটনে দিন কাটালেও কলকাতায় কেউ কেউ কুৎসা রটিয়েছিলো যে, মধুসূদন বিলাসিতায় মত্ত আছেন। এসব শুনে মধুসূদন আতঙ্কিত হয়ে বিদ্যাসাগরকে লিখেছিলেন যে, ’কুৎসাবাদীদের অপপ্রচারে বিশ্বাস করবেন না, আমার উপর আস্থা রাখবেন।’ বিদ্যাসাগর এসব কথায় কান না দিলেও মধুসূদনকে পাঠানো অর্থসাহায্য সংগ্রহ করতে তাঁকে নানা বেগ পোহাতে হয়েছিলো।

এছাড়া সঠিক সময়ে সেসব অর্থঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে, বিদ্যাসাগরকে নানাজনের কটূকথা এবং অপমানও সহ্য করতে হয়েছিলো। তবুও তিনি চেয়েছিলেন, যেকোনো মূল্যে মধুসূদনের পাশে থাকতে, যাতে তাঁর সাহিত্যচর্চা অব্যাহত থাকে। আর মধুসূদনও নানাভাবে বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার প্রকাশ করেছিলেন। প্যারিসে একটি দোকানে বিদ্যাসাগরের বই দেখতে পেয়ে উৎফুল্ল হন মাইকেল। বিদ্যাসাগরকে লেখেন, ‘প্যারিসের একটি দোকানে আমি তোমার একটি-দুটি বই দেখতে পেলাম। দোকানদারকে বললাম, এর লেখক আমার খুব কাছের একজন বন্ধু। সে বলল, আমরা ভেবেছিলাম এই বইগুলির লেখক মারা গেছেন। ঈশ্বর না করুন, আমি বললাম, তাঁর মৃত্যু স্বদেশ এবং বন্ধুরা কেউই মেনে নিতে পারবে না।’ এছাড়া গবেষক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, মধুসূদন তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ শোধপূর্বক শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে দায়মুক্ত করেছিলেন।

১৮৬৬ সালের ১৭ নভেম্বর মধুসূদন ব্যারিস্টারি পাস করে ১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় ফিরে আসেন। তাঁর ইচ্ছে ব্যারিস্টারি করা। তিনি এজন্যে ব্যবস্থা করে দিতে বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করেন। বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় মধুসূদন কলকাতায় ব্যারিস্টারি শুরু করলেও অমিতব্যয়িতার কারণে তাঁর কাছে অর্থ থাকত না। তিনি বন্ধুদের আপ্যায়নে প্রচুর খরচ করতেন। আয়ের কিছু অংশ ইউরোপে স্ত্রী-সন্তানদের পাঠাতেন। অনেকসময় তিনি আদালতেও যেতে চাইতেন না। ফলে অভাব পিছু ছাড়তো না।

বিদ্যাসাগরের মতো সুহৃদ মাইকেল মধুসূদন দত্তের আর ছিল না। তাঁর জীবনীকার সত্যই লিখেছেন, 'বিদ্যাসাগর মহাশয় যদি সাহায্য না করিতেন, তাহা হইলে, মাইকেলকে নিশ্চিতই অনাহারে মরিতে হইত।' এ কথা কবি নিজেও ভালো করে জানতেন। তাই তিনি নানাভাবে বিদ্যাসাগরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। কোনো পত্রে বিদ্যাসাগরকে তিনি 'করুণার সাগর', কোনো পত্রে 'সত্যিকার বন্ধু ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মধুসূদন এক পত্রে বিদ্যাসাগরকে লিখেছেন, 'আপনি জানেন, পৃথিবীতে এমন কোনো কর্ম্ম নাই, যাহা আমি আপনার জন্য করিতে কুণ্ঠিত হইব।' কবি তাঁকে 'বীরাঙ্গনা কাব্য' উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন, 'বঙ্গকূলচূড় শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয়ের চিরস্মরণীয় নাম এই অভিনব কাব্যশিরে শিরোমণিরূপে স্থাপিত করিয়া, কাব্যকার ইহা উক্ত মহানুভবের নিকট যথোচিত সম্মানের সহিত উৎসর্গ করিল।'

তাদের বন্ধুত্ব ছিলো বেশ আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ, তাতে অধিকারবোধের প্রাবল্যও কম ছিলো না। দেনা-পাওনার টানাপোড়েনে তাঁদের বন্ধুত্বে এতটুকুও চিড় ধরেনি। সুবলচন্দ্র মিত্রের বইয়ে বিদ্যাসাগরকে লেখা মাইকেলের একটি দুর্লভ চিঠি পাওয়া যায়। মাইকেল লিখছেন, ‘আমার সহকর্মী বাবু মূর্তিলাল চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে তোমার কাছে যাব। তুমি এক বোতল শেরি আনিয়ে রেখো’। বিদ্যাসাগর শেরি আনিয়েছিলেন কিনা আমরা জানতে পারিনি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের কাছে মদ আনিয়ে রাখার আবদার মাইকেল ছাড়া আর কেইই বা করতে পারতেন।

যদিও মৃত্যুর কিছুকাল পূর্ব থেকে নানান জীবন জটিলতায় তাদের সম্পর্কে কিছুটা ফাটল ধরেছিলো। তবে বিদ্যাসাগরের আপামর সহযোগিতা ছাড়া মধুসূদনের সাহিত্যজীবনে সমৃদ্ধিলাভ সম্ভবপর ছিলো না। কারণ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে বিদ্যাসাগর অনেকটাই একা হাতে সামলে নিয়েছিলেন বহুকাল।  মধুসূদনের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে বিদ্যাসাগরের কাছে অর্থসাহায্য চাইতে গেলে তিনি বলেছিলেন, 'দেখ প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া যাহার জান্ রাখিতে পারি নাই, তাহার হাড় রাখিবার জন্য আমি ব্যস্ত নই...।'

লেখক: শিক্ষক গবেষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর