প্রকাশনা জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র

, শিল্প-সাহিত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 15:57:54

শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রকাশনা শিল্পের উজ্জ্বল নক্ষত্র মহিউদ্দিন আহমেদ (জন্ম- ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪, মৃত্যু-২১ জুন ২০২১) ৭৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেছেন। তিনি ছিলেন স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)-এর প্রতিষ্ঠাতা, ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ’ বিনির্মাণের পথে অগ্রণী সারথি এবং বাংলাদেশের ফিকশন, নন-ফিকশন প্রকাশনাকে আন্তর্জাতিক স্তরে উত্তীর্ণকারী একজন সফল ও সর্বজনমান্য প্রকাশক। 

প্রকাশনার সামগ্রিক উৎকর্ষ সাধনে মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব। ভালো লেখা, গবেষণা বা সাহিত্যকর্ম যাই হোক, সেটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নন্দনতাত্ত্বিক সৌকর্ষে উপস্থাপন করার কৃতিত্বে তিনি দীপ্যমান। যে কারণে তাঁর নেতৃত্বে ইউপিএল ১৬ বার জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার পেয়েছে, ১৯৯১ সালে লাভ করে স্বর্ণপদক। ১৯৮৮ সালে তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনার ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ‘পাবলিশিং ম্যানেজমেন্ট’-এ ‘কালচারাল ডকটরেট’ প্রদান করে এবং ২০১৪ সালে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতি তাঁকে ‘ইমেরিটাস প্রকাশক’ সম্মাননা প্রদান করার মাধ্যমে জীবনব্যাপী পেশাগত সাফল্যের স্বীকৃতি জানায়। বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র ও প্রথম এমন স্বীকৃতি পেয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়া বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এমন সাফল্যজনক কৃতিত্ব বিরল।

১৯৭৫ সালে ইউপিএল প্রতিষ্ঠার আগে মহিউদ্দিন আহমেদ আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস-এ সম্পাদক রূপে দায়িত্ব পালন করেন। বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং বৃত্তিসহ পিএইডি গবেষণার সুযোগ পেয়েও তিনি প্রকাশনা শিল্পকে নিজের কর্মক্ষেত্র রূপে বেছে নেন এবং আজীবন মেধা, শ্রম ও প্রেমের মাধ্যমে এই ক্ষেত্রে কিংবদন্তির মর্যাদা লাভ করেন।   

ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনে প্রথম কোনও প্রকাশকের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ মধ্য আশি থেকে নব্বই দশকের শুরুতে ঢাকার মতিঝিলের রেডক্রস ভবনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল)-এর মাধ্যমে। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এবং ইত্তেফাক ভবনের ইংরেজি দৈনিক ‘নিউনেশন’ ও সাপ্তাহিক ‘রোববার’র সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমেরিকার উইসকনসিন থেকে প্রফেসর জিল্লুর রহমান খান (১৯৩৮-২০২১) ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে জাহাঙ্গীরনগরের ‘সরকার ও রাজনীতি’ বিভাগের ¯œাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়াতে আসেন, যে শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলাম আমরা। উইলিয়াম শেকসপিয়ারের নাটক অবলম্বনে ঢাকার টেলিভিশনে ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ নামের বিখ্যাত নাটকের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান অভিনেতা। তিনি ছিলেন বিশ্বসেরা স্থপতি এফ. আর. খানের ছোটভাই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য করা প্রয়োজন যে, একই বছরে এবং একই শ্রেণিতে, অন্য একটি কোর্সে আমাদের আরেক অতিথি অধ্যাপক ছিলেন প্রখ্যাত সরদার ফজলুল করিম (১ মে ১৯২৫-১৫ জুন ২০১৪)। একদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নাট্যশিল্পী জিল্লুর রহমান খান পড়াতেন নাটকীয়তা ও চমকের মাধ্যমে। আর সরদার ফজলুল করিম উদার, মুক্ত ও সরল আঙিকে পাঠদানের মাধ্যমে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন শিক্ষার্থীদের মৌলিক প্রতিভা ও চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটানোর কাজে।  

স্পষ্ট মনে আছে, মধ্য আশি দশকের কোনও একদিন প্রফেসর জিল্লুর রহমান খান তাঁর বইয়ের প্রকাশক ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)-এর মহিউদ্দিন আহমেদের অফিসে গেলেন আমাকেও সঙ্গে নিয়ে। স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল সেসব ঘটনা। ঢাকার বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের রেডক্রস বিল্ডিং-এ সে আমলের বিবেচনায় আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও সুপরিসর ইউপিএল অফিস দেখে বিমোহিত না-হয়ে উপায় ছিল না। ১৯৭৫ প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন আহমেদের ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনার সঙ্গে বহু বছর কাজ করা বাস্তব পূর্ব-অভিজ্ঞতা, যার প্রমাণ তাঁর পেশাগত নৈপুণ্য, বিশুদ্ধতায় ও কৃতিত্বে সুস্পষ্ট। প্রকাশক রূপে তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক, উভয় দিক দিয়ে তার উচ্চতর অবস্থানের প্রমাণবহ তাঁর হাতে গড়া ‘ইউপিএল’ এবং তাঁর রচিত বাংলাদেশে পুস্তক প্রকাশনা বিষয়ক গ্রন্থ। যে কারণে একটি কথা, সর্বাংশে সত্য না হলেও, প্রচলিত ছিল যে, ‘ইউপিএল-এর বাইরে দেশের প্রকাশনীগুলোর অধিকাংশই অদ্যাবধি আকারে মুদি দোকানের পর্যায়ের, আর প্রকারে অশিক্ষিত-অরুচিকর-অগোছালো-অস্বাস্থ্যকর পরিবারতুল্য’। রাখাল রাহার এই মন্তব্য (‘বাংলাদেশের প্রকাশনা ও জ্ঞানের জগতের হালচাল’, বিডিনিউজ২৪.কম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩) কিছু ব্যতিক্রম বাদে বহুলাংশে সত্য।

প্রথম সাক্ষাতের দিন প্রবাদপ্রতীম মহিউদ্দিন সাহেব ইউপিএল’র ভেতরের দিকে একটি কেবিনে কাপজ-পত্র ভর্তি টেবিলে বসে ছিলেন। আমরা আসন নিলাম রুমের এক চিলতে লম্বা সোফায়। কিছুক্ষণ পরেই কফি চলে এলো। ঢাকায় তখন কফি মোটেও সুলভ পানীয় নয় এবং বাণিজ্যিকভাবে কফির প্রচলন ছিল না। বিশেষ দুয়েকটি জায়গায় কফি পাওয়া যেত না। মহিউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে সেই যোগাযোগ আমার অক্ষুন্ন থাকে অনেক বছর। তিনি আমার পাঠের আগ্রহ অনুযায়ী রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজ ও অর্থনীতি বিষয়ক অ্যাকাডেমিক বই রিভিউ করার জন্য দিতেন এবং আমি সেগুলো ইত্তেফাক, নিউ নেশন ও রোববার-এ ছাপাতাম। এ কথা অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার যে, প্রতিটি রিভিউ-এর জন্য তিনি আমাকে সম্মানজনক সম্মানী দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। ইত্তেফাকে তখন একটি গল্পের জন্য একশত আর কবিতার জন্য পঞ্চাশ টাকা সম্মানী পাওয়া যেত। মহিউদ্দিন সাহেবের ইউপিএল পাঁচশ টাকা সম্মানী দিত রিভিউ-এর জন্য। কয়েক দিন পর পর বই ও কফি পানের টানে ইউপিএল অফিসে মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে গেলে হিসাব বিভাগের হিন্দু ভদ্রলোক (নাম মনে নেই, কিশোরগঞ্জ শহরের খড়মপট্টি এলাকায় বাড়ি ছিল) হাজার পাঁচেক টাকার চেক দিতেন, যা তখনকার বা এখনকার দিনে কোনও প্রকাশক দেন বা দিতে পারেন বলে মনে হয় না। 

মহিউদ্দিন সাহেব একটি বইকে দেখতেন একটি প্রজেক্টের মতো। অত্যন্ত প্রফেশনাল দৃষ্টিভঙ্গিতে নৈর্ব্যক্তিভাবে বাজার পর্যালোচনা করে তিনি বইয়ের খরচ ও বিক্রয় ক্ষেত্র বা মুনাফা ক্যালকুলেশন করেই বই বের করতেন। ফলে রিভিউ-এর খাতেও টাকা ধরা থাকতো। তবে পা-ুলিপির বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ হলে ঝুঁকি নিয়েও তিনি বাংলাদেশের ফিকশন ও নন-ফিকশন সাহিত্য ক্ষেত্রে বহু বই প্রকাশ করেছেন। যার মধ্যে শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস আছে, আছে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্মৃতিকথাসহ অসংখ্য গ্রন্থ এবং তাঁর সম্পাদিত বাংলাদেশের প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা সিরিজ অন্যতম। কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি ছিলেন কঠোর ও পক্ষপাতহীন। তিনি মানহীন ও অমনোনীত বই কোনও চাপের মধ্যেও প্রকাশ করতেন না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকর্মীর, যিনি উত্তর আমেরিকার ডিগ্রিধারী ও পরবর্তীতে এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন, তাঁর বই মানসম্পন্ন না হওয়ায় অবলীলায় সেটি ফেরত দিয়েছেন আমার মাধ্যমে। ইউপিএল’র বইয়ের তালিকা বা ‘ক্যাটালগ’-এ নজর দিলে যে আলোকময় গ্রন্থরাজির নাম দেখতে পাওয়া যায়, তা মহিউদ্দিন আহমেদের রুচি, মনন ও সার্বিক তত্ত্বাবধানের ফসল।

ইউপিএল প্রকাশনা সংস্থা মহিউদ্দিন আহমেদের আলোকোজ্জ্বল ঐতিহ্য পেরিয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে তাঁর মেয়ে মাহরুখ মহিউদ্দিনের সুদক্ষ পরিচালনায়। প্রচারবিমুখ, জীবনভর নিজের কাজে নিমগ্ন মহিউদ্দিন সাহেব সম্পর্কে বিশেষ লেখাপত্র নেই, যদিও বাংলাদেশের প্রকাশনার ইতিহাসের জন্যেই তা থাকা দরকার। এক্ষেত্রে একটি লেখা লিজেন্ডারি প্রকাশক সম্পর্কে পাঠকদের আরও তথ্য দিতে পারে। তা হলো: Mayabee Arannya, (‘An Unparalleled Veteran in the World of Publishing’,Daily Star, 17 February, 2020)।  মৃত্যুর পর মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণে তাঁর জীবন ও কর্মের বহু অধ্যায় ও বিষয় উন্মোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের ইতিহাসের মতোই ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনা পাওয়া সম্ভব তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা আর কর্মের দ্যুতির মাধ্যমে।  

শুরুতে মহিউদ্দিন সাহেবের পার্টনার ছিলেন হাবিবুর রহমান সাহেব, যিনি পরে অ্যাকাডেমিক পাবলিশার্স গড়েছিলেন। বই বিপণন সংক্রান্ত কাজে প্রায়ই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন। বেশ পরিশ্রমী ভদ্রলোক ছিলেন তিনি। তিনি প্রয়াত হওয়ায় তাঁর স্ত্রী শাহিনা রহমান প্রতিষ্ঠানটি দেখাশোনা করেন এবং তাঁদের পারিবারিক সুহৃদ ড. মিজানুর রহমান শেলী প্রকাশনার খোঁজ-খবর রাখতেন। প্রতিষ্ঠানটি পরে আর দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু মহিউদ্দিন আহমেদ জীবনের ম্যারাথন রেস পেরিয়ে পরিণত হয়েছেন মহীরুহে। ফেনীর সীমান্তবর্তী এক অঞ্চলে জন্ম নিলেও পিতার চাকরির সুবাদে তিনি লাভ করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের এবং তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের নানা অভিজ্ঞতা। তাঁর সঙ্গে পড়াশোনা ও কর্মের সুবাদে যোগাযোগ হয়েছে বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের। ফলে তিনি অর্জন করেছিলেন বহুমাত্রিক বীক্ষণের ক্ষমতা এবং দূরদৃষ্টি, যা সারা জীবন তিনি উজাড় করে নিজের পছন্দের প্রিয়তম ক্ষেত্রে ঢেলে দিয়ে হয়েছেন প্রকাশনা জগতের ‘উজ্জ্বল নক্ষত্র’।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর