প্রিয় বেলাল ভাই, আপনাকে ছাড়া এই প্রথম আপনার জন্মদিন এলো। আপনি স্পর্শ করলেন ৮০ বছর। এ বছরটিতেই আপনি চলে গেলেন।
বেলাল চৌধুরী (জন্ম ১২ নভেম্বর ১৯৩৮-মৃত্যু ২৪ এপ্রিল ২০১৮) ৮০ বর্ষস্পর্শী এক তুর্কি তরুণ হয়ে রয়েছেন আমাদের মানসপটে। যারা তাঁকে নিবিড় ভাবে জানি, তাদের কাছে কবি, লেখক, সম্পাদকের পরিচিতি ছাপিয়ে উষ্ণ, হৃদয়বান, মজলিসি বেলাল চৌধুরী অনেক বেশি স্পষ্ট, অনন্য ও জীবন্ত।
ব্যক্তিগতভাবে উভয় বাংলার প্রায়-সকল কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড়তম সংযোগ-সম্পর্ক। মানুষকে আপন করে কাছে টেনে নেয়ার জাদুকরী গুণ ছিল তার আয়ত্তাধীন। সামান্য পরিচয়কে দীর্ঘ দিনের স্মৃতিপটে ধরে রাখতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। বড় ভালোবাসার মানুষ ছিলেন আপনি।
আমরা যখন তাঁর সান্নিধ্য-ধন্য তখন তিনি 'ভারত বিচিত্রা' সম্পাদক, বসেন ধানমন্ডির ২নং সড়কে। আশির দশকের সেই দিনগুলোতে তিনি পেরিয়ে এসেছেন তাঁর সুদীর্ঘ-বর্ণিল জীবনের পশ্চিমবঙ্গ পর্ব। সাপ্তাহিক সন্ধানী'র দিনগুলোও তখন অতীত। একটি দূতাবাসের অবাণিজ্যিক সাময়িকী নিয়ে তখন তার প্রাত্যহিক কাজ-কারবার।
কিন্তু কে বলবে, তিনি একটি ডিপ্লোম্যাটিক ভবনের চৌহদ্দীতে? যতবার গিয়েছি, দেখেছি জমজমাট আড্ডা। বারোয়ারী মানুষের ভিড়। লেখা আর ভিসার তদবির চলছে পাশাপাশি। জনসংযোগের এমন ঈর্ষণীয় ক্ষমতা খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। মানুষকে টেনে আনার জাদুকরী গুণ আপনার মতো আর কে দেখাতে পেরেছে!
পরিচয়ের বৃত্ত ছিল পৃথিবীর মতো বিপুলা ও বৈচিত্রময়। কত রকম মানুষের কতো রকম বিষয় যে বেলাল ভাই সামাল দিয়েছেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। এসব নানাবিধ কাজ করেও তিনি 'ভারত বিচিত্রা'কে উচ্চাঙ্গের পত্রিকায় পরিণত করেন। বাংলাদেশের প্রধান ও তরুণ লেখকদের প্রায়-সবাইকে তাঁর পত্রিকায় নিয়ে আসেন।
বিরাট মাপের সম্পাদক ছিলেন তিনি। সাহিত্যের নাড়ি-নক্ষত্র সবই তাঁর জানা। বেলাল ভাই জানতেন, কার হাতে কোন লেখাটি ভালো হবে। কাকে কোন লেখার সুযোগ দিতে হবে। আমাকে দিয়ে চট্টগ্রামে প্রায়-অজ্ঞাতবাসে থাকা সুচরিত চৌধুরীর গল্প, স্মৃতি ইত্যাদি সংগ্রহ করেও ছাপিয়েছেন। এমনই তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে তিনি দুর্লভ লেখা সংগ্রহ করিয়েছেন।
অফিস ছাড়াও পুরনো পল্টনে তাঁর পুরনো বাড়িতে গিয়েছি, যেখানে তার ছোট ভাই সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীও বসবাস করতেন। দুই ভাইয়েরই ছিল বিশাল জনসংযোগ সাম্রাজ্য। হাজার মানুষের শত রকমের তদবিরে চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন অক্লান্ত।
কখনো শাহবাগ, এলিফ্যান্ট রোডের লাটিমীতে কফি পানের জন্য বসেছি আমরা। সেসব দিন আজকের মতো ভীড়াক্রান্ত ছিল না, ছিল আয়েশী ও সহনীয়। 'লাটিমী' নামের যে একটি খাবার ঘরে আমরা নিয়মিত বসেছি, সে দোকানটি এখন আর নেই। কিন্তু তাঁর আলাপের তরঙ্গ এখনো তাজা প্রবাহে আচ্ছন্ন করে আমাকে। কত মানুষের কত বিচিত্র তথ্য যে তিনি জানতেন! এনসাইক্লোপিডিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের সম্পর্কে বেলাল চৌধুরীর ছিল সরাসরি অধীত জ্ঞান। একটি উল্লেখযোগ্য সময় কলকাতায় বসবাসের সুবাদে সেখানকার সাহিত্য পরিমণ্ডলের যাবতীয় তথ্য ছিল তাঁর নখাগ্রে। নিখুঁত ও নিটোল বিবরণে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিষয়কে তুলে ধরতে পারতেন। কবি বিষ্ণু দে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি রিখিয়া ও উশ্রী নদীর যে নান্দনিক চিত্র উপস্থাপন করেন, তা এখনো আমার স্বপ্নে কড়া নাড়ে। খালাসীটোলার কমলকুমার মজুমদারকে মনে হয় পাশে বসে আছেন।
বেলাল চৌধুরীর মৃত্যুর পর আমার বুক সেলফে আশ্রত 'প্রাণের পত্রাবলি' নামে তাঁকে লেখা দুই বাংলার কবি-লেখকদের পত্রগুচ্ছ সংগ্রহটি আবার হাতে নিয়ে স্মৃতির স্রোতে ভেসে গেলাম। আলাপে-আড্ডায় তিনি যত মানুষের গল্প করেছেন, তারচেয়েও বেশি মানুষের সঙ্গে ছিল তার সখ্য, সংযোগ ও সম্পর্ক। বেলাল ভাইকে লেখা চিঠির হাত ধরে যেন খুলে গেছে এক-একজন চেনা মানুষের অজানা-অদেখা জগৎ। তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে উভয় বাংলার সাহিত্যের আস্ত একটি যুগ।
বেলাল চৌধুরীর মৃত্যুতে একটি বর্ণময় কালের অবসানই শুধু হয় নি, বৃহত্তর বঙ্গ সাহিত্যের সংযোজক সেতুটিও ব্যথা জাগানিয়া পতন-ধ্বনির আর্তনাদে ভেঙে পড়েছে। তাঁর মতো বর্ণিল মানুষের দেখা খুব সহজেই পাওয়া সম্ভব হবে না। বহু বহু বছর পর বেলাল চৌধুরীর মতো অনন্য মানুষের দেখা পাওয়া যায়। তাঁর ৮০তম জন্মদিনে তাঁর দেখা না-পাওয়া বড়ই বেদনার। বড়ই হাহাকারের।
প্রিয় বেলাল ভাই, শুভ জন্মদিন।