তিনি বলেছিলেন, ‘তার মৃত্যুতে কেউ যেন না কাঁদে।’ কিন্তু পুরো বাংলাদেশ কেঁদেছিল সেদিন, যেদিন তিনি স্বদেশের বহুদূরে আমেরিকায় মারা যান। হুমায়ূন আহমেদের জন্য শ্রাবণ মেঘের দিনের মতো কেঁদেছে মানুষ।
বাংলাদেশের এই জননন্দিত লেখক-পরিচালক-গীতিকার হুমায়ূন আহমেদের
৭০তম জন্মদিন মঙ্গলবার (১৩ নভেম্বর)।
হুমায়ূন জন্মেছিলেন ১৯৪৮ সালে হাওর-বাওর-গানের দেশ বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে, নানাবাড়িতে।
একই জেলার কেন্দুয়ার কুতুবপুর তার পিতৃভূমি।
মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদ, পুলিশ অফিসার বাবার জেষ্ঠ্য সন্তান তিনি। লেখক জাফর ইকবাল ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবিব তার অনুজ। প্রথম স্ত্রী গুলকেতিন আহমেদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ঘর বাঁধেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে নিয়ে।
পিতার চাকরির সুবাদে হুমায়ূনের শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশের বহু স্থানে। সিলেটের মীরাবাজার, চট্টগ্রাম শহর, পিরোজপুরের মনকাড়া প্রকৃতির কথা তার লেখায় বার বার ফিরে এসেছে।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নের স্নাতকোত্তর পাশ করেন তিনি।
পিএইচডি ডিগ্রি নেন আমেরিকার থেকে।
শুরু করেন অধ্যাপনা। কিন্তু তার ভাগ্য মিশে ছিল সাহিত্যে। 'শঙ্খ নীল কারগার’ ও ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে তার বিপুল জনপ্রিয় লেখক জীবনের সূচনা ঘটে।
গল্প-উপন্যাসের জাদুকরী ক্ষমতায় বিপুল পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেন তিনি। মানুষ লাইন ধরে কিনে তার বই। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয় হাজার হাজার কপি।
‘অচিনপুর’, ‘মেঘ বলেছে যাবো যাবো’, ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’ ‘লীলাবতী’, ‘মধ্যাহ্ন’ এমন তিন শতাধিক পাঠকনন্দিত উপন্যাসের রচয়িতা হুমায়ূন আহমেদ।
টিভি নাটকেও জনপ্রিয়তার ইতিহাস গড়েন তিনি। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘অয়োময়’ ‘দূরে কোথাও’ এমন হৃদয়ছোঁয়া নাটকের মাধ্যমে ছোটপর্দায় টেনে আনেন হাজার হাজার দর্শক।
চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও সোনা ফলিয়েছেন হুমায়ূন। সিনেমাহলমুখী করেছেন মানুষকে। লোকায়ত বাংলার গীত সম্ভার তিনি তুলে ধরেন রূপালি পর্দায়। তার নির্মিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী, ‘ঘেটু পুত্র কমলা’র মতো ছবি বাণিজ্য সফল ও পুরস্কৃত হয়েছে। নাটক ও চলচ্চিত্রে তিনি লোক বাংলার বহু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ তার সৃষ্টির পুরোটাজুড়েই আছে।
হুমায়ূনের উপন্যাস ‘১৯৭১’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘উতল হাওয়া’ এবং চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশ মনি’ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের হৃদয়স্পর্শী কাহিনীচিত্র।
যুদ্ধাপরাধ, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখার পাশাপাশি আন্দোলনও করেছেন তিনি।
প্রেম ও রহস্যময় বেদনার প্রতীক নগ্নপদে হলুদপাঞ্জাবির ‘হিমু’ তার অনবদ্য সৃষ্টি।
যুক্তিবাদী বিশ্লেষক মিসির আলীর মতো চরিত্রও তিনি সৃষ্টি করেছেন। হুমায়ূনের এই দুই চরিত্রের কথা বাংলা সাহিত্যের পাঠক সহজে ভুলবে। ভুলবে না এমন অনেক মানবিক চরিত্র ও কাহিনীর নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদকেও।
নীল জোছনায় বেদনাহত একটি তরুণ
কিংবা নীলপদ্ম হাতে একটি তরুণীর
অন্তর্গত আনন্দ ও বিষাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন অবিস্মরণীয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। বেঁচে থাকবেন জোছনা-প্লাবিত চান্ন পসর রাইতের মায়াময় দোলায়।
তার ৭০তম জন্মদিনে বার্তা২৪.কমের অসীম শ্রদ্ধা।