রহস্যময়ী চরিত্র আনারকলি

, শিল্প-সাহিত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 03:58:03

আনারকলির চরিত্র ও সংশ্লিষ্ট ঘটনার সত্যাসত্য খুঁজতে যেতে হবে ষোড়শ শতাব্দীর মুঘল শহর লাহোরে। যদিও লাহোর শহরের প্রতিষ্ঠা আরও প্রাচীনকালে। হিন্দু পৌরাণিক আমল, মুসলিম গজনভী, ঘোরী, সুলতানী এবং শিখ শাসনের লাহোরের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। তবে, ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে লাহোর মুঘল সাম্রারাজ্যের অধীনে জাঁকজমক ও সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে পৌঁছে। এমনকি, দুই দফায় বেশ কয়েক বছর ধরে (১৫৪০-১৫৫৪ এবং ১৫৮৬-১৫৯৮) লাহোর সমগ্র ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের রাজধানী ও কেন্দ্রবিন্দু ছিল। আগ্রা, দিল্লি, ফতেহপুর সিক্রি ছাড়া একমাত্র লাহোর শহরকেই মুঘলরা রাজধানীর মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং লাহোরকে পরিণত করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক শহরে।

মুঘল-স্মৃতিধন্য পুরনো লাহোর শহরের মাঝখানে মধ্যযুগীয় স্থাপত্য-ধ্বংসাবেশ নিয়ে একটি পরিকল্পিত বাণিজ্যকেন্দ্র আছে, যার নাম আনারকলি বাজার। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসিত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার সময় পাঞ্জাবেরও বিভাজন হয়। অবিভক্ত পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোর পড়ে পাকিস্তানের অংশে। বর্তমানেন পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর আর সেখানে পুরনো আনারকলি বাজারের পাশেই রয়েছে পাঞ্জাব প্রদেশের সচিবালয় এবং তারই পাশে এক বিস্ময়কর ও রহস্যঘেরা সমাধিসৌধ। লোকমুখে ও লিখিত রেকর্ডে সবাই একে আনারকলির সমাধি বলেই জানেন। সমাধির গায়ের এপিটাফ থেকে জানা যায়, যিনি এখানে শায়িত আছেন, তার মৃত্যুর সময়কাল ১৫৯৯ সাল। তখন সম্রাট আকবর (জন্ম ১৪ অক্টোবর ১৫৪২-মৃত্যু ২৭ অক্টোবর ১৬০৫) মুঘল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত (শাসনকাল ২৭ জানুয়ারি ১৫৫৬-২৭ অক্টোবর ১৬০৫=৪৯ বছর ৯ মাস)। এবং এই কবরবাসীর মৃত্যুর বছরই আকবরের ইচ্ছায় লাহোর থেকে রাজধানী আগ্রায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। প্রাপ্ত রেকর্ড অনুযায়ী, ১৬১৫ সালে সমাধিটি যখন পুনঃসংস্কার ও ব্যাপকতর ভৌত কাঠামোয় রূপান্তরিত করা হয়, তখন আকবরপুত্র শাহজাদা সেলিম তথা সম্রাট জাহাঙ্গীর (জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৫৬৯-মৃত্যু ২৮ অক্টোবর ১৬২৭) ছিলেন মুঘল ক্ষমতায় (শাসনকাল ১৫ অক্টোবর ১৬০৫-৮ অক্টোবর ১৬২৭=২১ বছর ১১ মাস ২৩ দিন)।

উপমহাদেশের অপরাপর রাজকীয় মুঘল প্রাসাদ, সৌধ, দুর্গ ও স্থাপনার মতোই নান্দনিক সৌন্দর্যে ও আভিজাত্যে ভরপুর সমাধিটি। মধ্যযুগে, মুঘল রাজতন্ত্রের আবহে কোনও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সম্রাটের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্মাণের প্রশ্নই আসে না। আকবরের আমলে নির্মিত ও জাহাঙ্গীরের আমলে সংস্কারকৃত হওয়ার মাধ্যমে মার্বেল পাথর দিয়ে খচিত সমাধির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। তদুপরি, সমাধির গায়ে তৎকালীন রাজভাষা ফারসিতে লেখা আছে একটি প্রেমময় কবিতা, যার তাৎপর্য সবারই মনোযোগ আকর্ষণ করে। কবিতায় বলা হয়েছে:

‘তা কিয়ামাত শোকর গুইয়াম কারদিগারি কিশ রা আহ

গার মান বাজ বিনাম রু ইয়ার-ই-খুশ রা’

[আমি যদি আমার প্রিয়তমার মুখটি আবার দু’হাতে ছুঁতে পারতাম

তবে কেয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতাম।]

এতো সুন্দর কবিতা কেবলমাত্র একজন নিষ্ঠাবান প্রেমিকই তার প্রিয়তমার জন্য রচনা করতে পারেন। কবির নামও সমাধির নিচেই উল্লেখ করা আছে ‘মজনু সেলিম’। সেই কবি আর কেউ নন। তিনি হলেন সম্রাট আকবরপুত্র শাহজাদা সেলিম বা সম্রাট জাহাঙ্গীর। মজনু মানে প্রেমিক আর সেলিম তার ডাক নাম। সম্রাট এই বিশেষ সমাধিসৌধের সান্নিধ্যে প্রেমিক রূপে আবির্ভূত।

আনারকলি কাল্পনিক চরিত্র হলে তার কবরে রাজকীয় ইমারত নির্মিত হবে কেন এবং কবরের গায়ে শাহজাদা সেলিমের নামে উৎকীর্ণ কবিতা কোথা থেকে আসবে? সম্রাট আকবরই বা কেন আনারকলির মৃত্যুর বছর কোনও রাজনৈতিক কিংবা সামরিক কারণ ছাড়াই রাজধানী লাহোর থেকে সরিয়ে নেবেন? আর মুঘল সম্রাট পদে আসীন হয়ে শাহজাদা সেলিম কেন তার সমাধিসৌধকে মুঘল ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় স্থাপনার মতোই গুরুত্ব দিয়ে বেলে আর মার্বেল পাথরে সুরম্যভাবে নির্মাণ করবেন? কেন তিনি সেখানে নিজের নামে রচিত সুস্পষ্ট প্রেমের বাণীকে কবিতায় উৎকীর্ণ করবেন? কেন তিনি শেষ জীবনে বার বার লাহোরে চলে আসবেন এবং লাহোরেই নিজের শেষ বিশ্রামের স্থান নির্ধারণ করে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন?

এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আনারকলির অস্তিত্ব ও উপস্থিতির পক্ষেই যায়। আরেকটি ইতিহাসসিদ্ধ ঘটনা আনারকলির প্রসঙ্গকে বাস্তবতা দান করেছে। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায় যে, আনারকলির সঙ্গে শাহজাদা সেলিমের প্রেম ও প্রণয়ের বিষয়টি সম্রাট আকবরের নজরে আনেন আবুল ফজল (জন্ম ১৪ জানুয়ারি ১৫৫১-মৃত্যু ২২ আগস্ট ১৬০২)। আবুল ফজল ইবনে মুবারক আল্লামা ছিলেন আকবরের অন্যতম মন্ত্রী ও ‘নবরত্ন’ সভার অন্যতম সদস্য। আকবরের উপর আবুল ফজলের প্রভাবও ছিল অপরিসীম। আবুল ফজলের গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হলো সম্রাট আকবরের শাসনকালে বিস্তারিত ইতিহাস তিন খণ্ডের ‘আকবরনামা’ রচনা, যার তৃতীয় খণ্ডের শিরোনাম ‘আইন-ই-আকবরি’।

আনারকলির সঙ্গে প্রেম ও প্রণয়ের ঘটনাটি জেনে গুরুত্বপূর্ণ সভাসদ আবুল ফজলের পরামর্শে সম্রাট আকবর শাহজাদা সেলিমকে রাজধানী থেকে দূরে পাঠিয়ে দেন এবং এই অবসরে দরবারের নর্তকী আনারকলিকে শাহজাদার জীবন ও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেন। সে সময় একাধিক বার সম্রাট ও পিতা আকবরের বিরুদ্ধে সামরিক বিরোধিতা ও বিদ্রোহের পেছনে সিংহাসন লাভের বাসনা ছাড়াও ব্যক্তিগত এই বেদনার দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন শাহজাদা সেলিম । পিতা-পুত্রের তীব্র ক্ষমতার দ্বন্দ্বের নাটকীয়তা আনারকলির মৃত্যুর বেদনা আড়াল করলেও শাহজাদা সেলিম তা মোটেও ভুলে যান নি। ১৬০২ সালে আবুল ফজল যখন দক্ষিণ ভারত থেকে রাজধানীকে ফিরে আসছিলেন, তখন পথিমধ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে মাত্র ৫১ বছর বয়সে নিহত তিনি। মুঘল ইতিহাস নিয়ে গবেষণাকারী পরবর্তী প্রায়-সকল ঐতিহাসিকই আবুল ফজলের হত্যাকাণ্ডে শাহজাদা সেলিমের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছেন। এমনকি, শাহজাদা সেলিম বা সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি’ গ্রন্থে রাগ ও হিংসার বশবর্তী হয়ে আবুল ফজলকে হত্যা করানোর ঘটনা স্বয়ং লেখক শাহজাদা সেলিম তথা সম্রাট জাহাঙ্গীর উল্লেখ করেছেন।

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, দাক্ষিণাত্য থেকে দিল্লি ফিরছিলেন আকবরের দরবারের রাজঐতিহাসিক ‘আকবরনামা’র লেখক আবুল ফজল। কিন্তু জাহাঙ্গীরের বিশ্বস্ত সেনাপতি বীর সিং বুন্দেলার হাতে পথেই খুন হন তিনি। তারিখটি ছিল  ২২ আগস্ট ১৬০২ সাল, আনারকলির মৃত্যুর তিন বছর পরের এবং জাহাঙ্গীরের ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছর আগের ঘটনা। এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, জাহাঙ্গীরের সিংহাসনে বসতে বাধা দিয়েছিলেন আবুল ফজল। অনেকে মনে করেন, নর্তকী আনারকলিকে নিয়ে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আবুল ফজলের বিবাদের সূত্রপাত এবং এরই পরিণতিতে আবুল ফজলের হত্যাকা-। তবে মৃত্যুর আগে আবুল ফজল বলে যান, তিনি নির্দোষ। আনারকলিকে আকবর বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেনাপতি  ইলিয়াস খান। তথাপি আনারকলির ঘটনার সঙ্গে বুদ্ধিজীবী আবুল ফজলের নিহত হওয়ার বিষয়টিও ঐতিহাসিকভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

আবুল ফজল লেখক ও মন্ত্রণাদাতা ছিলেন, আকবরের রাজদরবারের অন্যান্যদের মতো সামরিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। আকবরের ‘নবরত্ন’ সভায় বুদ্ধিজীবী এবং পরামর্শক ছাড়াও অনেক সেনানায়ক অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। একমাত্র আবুল ফজল ছাড়া অন্য কেউই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন নি। ক্ষমতাগত রাজনৈতিক কারণ হলে শাহজাদা সেলিম সম্রাট আকবরের অন্যান্য সেনাপতিদের সঙ্গেও বিবাদ বা যুদ্ধ-সংঘাতে লিপ্ত হতেন বলে ইতিহাসে উল্লেখিত হতো। কিন্তু তা হয় নি। কেবল বুদ্ধিজীবী-লেখক আবুল ফজলই শাহজাদা সেলিমের আক্রোশের শিকার হয়ে প্রাণ হারান। এমনকি, সম্রাট আকবর তখনও ক্ষমতায় এবং প্রিয় সভাসদের মৃত্যুতে তিনি প্রতিশোধ নিতে পারেন জেনেও শাহজাদা সেলিম আবুল ফজলকে হত্যা করানোর পেছনে ভূমিকা পালন করেন। এতে ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট। অনুমান করা হয় যে, আনারকলির সঙ্গে প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটানো এবং তার করুণ মৃত্যুর জন্য আবুল ফজলের সক্রিয়তার কারণে শাহজাদা সেলিম তাকে হত্যা করান।  

আনারকলিকে ঘিরে এতো কিছুর পরেও মুঘল সরকারি ইতিহাসের কোথাও এই রহস্যময়ী নারীর কোনও উল্লেখ নেই। মুঘলরা সাধারণত ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় খুঁটিনাটি সকল বিষয় লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। প্রতিষ্ঠাতা বাবর থেকেই এই ঐতিহ্য বজায় রাখা হয়। ‘বাবুরনামা’, ‘হুমায়ুননামা’ ইত্যাদির মতোই আকবরের আমলে ‘আকবরনামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরি’ এবং জাহাঙ্গীরের আমলে ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি’ সমকালে ইতিহাসের অন্যবদ্য দলিল। পরবর্তী মুঘল সম্রাটগণও রাজকীয় ইতিহাস রচনার ধারা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেসব গ্রন্থে বহু বিচিত্র বিষয়ের উল্লেখ থাকলেও আনারকলি সম্পর্কে একটি শব্দ, এমনকি তার নামটি পর্যন্ত নেই! 

আরও অবাক বিষয় এটাই যে, আনারকলির নাম মুঘল ইতিহাসের কোথাও লিপিবদ্ধ না থাকলেও তিনি কয়েক শত বছর বিস্ময়করভাবে জীবন্ত রয়েছে লোকশ্রুতিতে। তার আখ্যান চর্চিত হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় এবং একাধিক চলচ্চিত্রে চিত্রিত হয়েছেন তিনি। এটাই বা সম্ভব হলো কেমন করে? কারণ, একেবারেই কাল্পনিক চরিত্রের স্থায়ীত্ব ও ব্যাপ্তি এতো বছর হওয়া প্রায়-অসম্ভব। সুদীর্ঘকাল সময় ধরে বিশাল জনগোষ্ঠী ও বিরাট ভৌগোলিক এলাকায় একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং একেবারেই অবাস্তব চরিত্র জীবন্ত থাকার বিষয়টিও অবিশ্বাস্য। ইতিহাসে ও বাস্তবে আসলেই এমন কেউ না থাকলে আনারকলি নামের চরিত্রকে নিয়ে এতোসব কা- বছরের পর বছর, হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ও শত শত মাইল এলাকায় কেমন করে ঘটতে পারলো? সুদূর অতীতের এমন এক রমণীকে ঘিরে উচ্চারিত প্রশ্নগুলোর সঠিক ও যথাযথ উত্তর আজ আর পুরোপুরিভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে আনারকলি বিরাজমান আছেন ইতিহাস ও মিথের সমান্তরালে। বাস্তব আর কল্পনার মিশেলে তার মতো এমন রহস্যময় চরিত্র ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল।   

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর