১১ ফেব্রুয়ারি কবি আসাদ চৌধুরীর জন্মদিন

, শিল্প-সাহিত্য

সাঈদ চৌধুরী | 2023-08-31 01:09:36

আজ ১১ ফেব্রুয়ারি কবি আসাদ চৌধুরীর জন্মদিন। ষাটের দশকের এই কবি বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র কাব্য ভাষা তৈরি করে নিজস্বতা অর্জন করেছেন। শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত। কালের সীমা অতিক্রম করে হয়েছেন কালোত্তীর্ণ।

আসাদ চৌধুরী একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আবৃত্তিকার। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। সাহিত্যে তিনি গণমুখী, নান্দনিক ও রোমান্টিক। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলার লোকায়ত জীবন সবই তাঁর লেখায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন।

আসাদ চৌধুরীর সাহিত্য সম্ভার সব ধরণের মানুষের পছন্দ। তথ্য ও ভাবনার রসদ পান সকল বয়সের পাঠক। বাংলা সাহিত্যে তাঁর সৃষ্টি ও কাজের ব্যাপ্তি একটি লেখায়  বুঝানো সহজ নয়। তাঁর কবিতা বা প্রবন্ধ পড়েই কেবল মননের গভীরতা উপলব্ধি করা সম্ভব হতে পারে।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব আসাদ চৌধুরীর কবিতায় আগুন জ্বলে। ‘নদীর জলে আগুন ছিলো/ আগুন ছিলো বৃষ্টিতে/ আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার/ উদাস-করা দৃষ্টিতে।/ আগুন ছিলো গানের সুরে/ আগুন ছিলো কাব্যে,/ মরার চোখে আগুন ছিলো/ এ-কথা কে ভাববে?/ কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায়/ ফোসে সাপের ফণা/ শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়/ জ্বলে বালির কণা।/ আগুন ছিলো মুক্তি সেনার/ স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়-/ প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে/ কাঁপছিলো সব-অন্যায়।/ এখন এ-সব স্বপ্নকথা/ দূরের শোনা গল্প,/ তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/ এখন আছি অল্প।’ (তখন সত্যি মানুষ ছিলাম)

’আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা/ তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়/ বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দ্যাখো/ ওটা একটা জল্লাদের ছবি/ পনের লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে/ মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলাটিপে হত্যা করেছে/ অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ/ বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়। (বারবার বি ডলারকে)

ফাগুন এলেই পাখি ডাকে/ থেকে থেকেই কোকিল বলবে? বলো।/ আমি যে তার নাম রেখেছি আসা/ নাম দিয়েছি ভাষা/ কতো নামেই তাকে ডাকি/ মেটে না পিপাসা... (ফাগুন এলেই)

কোথায় পালালো সত্য?/ দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো/ রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,/ গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,/ টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,/ নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।/ গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো,/ চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ,/ সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা,/ জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা,/ নকশী পাতিল, চৌকির তলা,/ সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো!/ সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে,/ কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে,/ ইনজেকশনে, দাঁদের মলমে,/ ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে/ ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রণ সেফে/ সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!/

কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই/ রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই/ পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই/ নাটকের কোন সংলাপে নেই/ শাসনেও নেই, ভাষণে নেই/ আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই/ রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,/ উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই/ লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই/ পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই/ হতাশায় নেই, আশাতেও নেই/ প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই/ এমন কি কালোবাজারেও নেই/ কোথায় গেলেন সত্য?/

যেতে যেতে মধ্যযুগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে/ মধ্যযুগ/ মুখ চুন করে/ দুহাতে পাঁজর চেপে/ ফিরে যাচ্ছে নিজ অন্ধকারে।/ নীল গগনের ললাটে চন্দন ছিল,/ সেখানে হংসমিথুন নয়/ বীরদর্পে পাক খাচ্ছে/ কয়েকটা শকুন/ কাকাতুয়ার মতন অনর্গল কলকল,/ ‘ক্ষমতা, ক্ষমতা…’/ যেতে যেতে/ হঠাৎ কী মনে করে/ ফিক করে হেসে/ মধ্যযুগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।/ কে দেখেছে, কে দেখেছে,/ দাদারা দেখেছে/ দিদিরা দেখেছে…( সত্য ফেরারী)

কবি আসাদ চৌধুরীর এধরণের কবিতা শুধু কাব্য গ্রন্থে সীমাবদ্ধ থাকেনা। বিপ্লবী জনতার মিছিলে ব্যানার হয়, পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড হয়। এমনকি দেয়ালিকা হয়।

টেলিভিশনে কিংবা বড় অনুষ্ঠানে শিল্প সাহিত্যের নান্দনিক উপস্থাপক আসাদ চৌধুরী তাঁর দর্শক ও শ্রোতাদের গল্প রসে মাতিয়ে রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহন কারী হিসেবে তিনি বেশ রাজনীতি সচেতন। আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ব্যাপারে খুবই স্পষ্টবাদি।

সম্ভবত ৯০ সালে বাংলা একাডেমিতে প্রথম পরিচয়। তাঁকে ঘিরে সেখানে তখন লেখক-গবেষকদের সমাহার দেখেছি। কল্যাণপুরের বাড়িতেও গিয়েছি। সিলেটে আমাদের অনেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছেন। আলোচানায় উপস্থিত লেখিয়েরা ঘন্টার পর ঘন্টা মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনেছেন তাঁর প্রাণবন্ত বক্তব্য।

শৈশব-কৈশোর কাল থেকেই মনশীল লেখক ও ভাল লেখার অনুসন্ধানী ছিলেন আসাদ চৌধুরী। এই অনুসন্ধানই যেন তাঁর জীবনের ব্রত। এখনো তিনি প্রচুর পড়েন। আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্ভার যেমন নখদর্পণে, একই সময়ে আমাদের নতুন প্রজন্মের ভাল লেখাও বাদ যায়না তাঁর নজর থেকে।

কবিতাই ছিল আসাদ চৌধুরীর প্রথম প্রেম। সেই কিশোর বয়সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ কবিতা পড়ে তিনি মুগ্ধ হন। গ্রামের বাড়িতে তাদের পাঠাগার ছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলী’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘বিষের বাঁশী’, সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ আর  সুকান্ত ভট্টচাযের্র ‘ছাড়পত্র’ ইত্যাদি ছেলে বেলায় পড়েছেন। অনেকগুলো কবিতাই মুখস্ত। তাই অল্প বয়স থেকেই তিনি লিখতে শুরু করেন। তাঁর  প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পান’ ব্যাপক আলোচিত ও সমাদৃত।

পান খেয়ে লাল ঠোটে যখন আবৃত্তি করেন, তখন তাঁকে অন্যরকম মনে হয়। বিশুদ্ধ উচ্চারণে পুরুষালি বলিষ্ঠতায় অসম্ভব সুন্দর আবৃত্তি। ‘রুপালি তবক দেয়া পান নিয়ে/ বসে আছি জানালায় গালে হাত দিয়ে/ সারারাত/ তিন/ দিন।/ আশুরা হয়েছে গত/ ক্ষত-/ জখমের মতো/ পড়ে আছে তাজিয়ারা সব/ রোদে গলা কাপড়ের শব।/ কলরব/ শেষ হলো।/ আতরের বাসে/ সেতারের সুর/ ঝুর ঝুর।/ রাত নিঝুমের/ ঘুমের স্বপ্ন থেকে/ গজল গেলেম এঁকে!/ দিবস খেলেম রজনী খেলেম।/ ‘অন্ধকার বালা?’/ মুজ্রা হাজির, অন্ধকারবালা। (প্রতীক্ষা)

‘তবক দেওয়া পান’ বের হয় ১৯৭৫ সালে। কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, অরুণাভ সরকার প্রমুখ তাঁর অসংখ্য কবিতা থেকে বাছাই করে প্রথম বই প্রকাশ করেন। বইটি  ঢাকার সাহিত্য পাড়ায় ব্যাপক ঝড় তুলে। এরপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ষাটের দশকের শীর্ষ কবিদের মধ্যে তিনি জায়গা করে নেন।

শুধু অসাধারণ লেখক নয়, উষ্ণ হৃদয়ের একজন প্রাণবন্ত মানুষ আসাদ চৌধুরী। সদা হাস্যময় ও প্রাণখোলা হৃদয়ের অধিকারী এবং প্রচন্ড আড্ডাবাজ। গল্পের আদলে কথা বলেন তিনি। তরুণদের কাছে টানেন সন্তানের স্নেহ দিয়ে। প্রবীনদের সাথে নবীন লেখকদের মেলবন্ধন সৃষ্টিতে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

আসাদ চৌধুরী গ্রামের মাটিতে জন্ম নিলেও রাজধানীর লেখক হিসেবে পরিচিত। তবে গ্রামীণ জনজীবনের প্রতি বরাবরই অকৃত্রিম টান অনুভব করেন। শুধু তাঁর গ্রাম নয়, পুরো দেশটা তিনি চষে বেড়িয়েছেন বারবার। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

আসাদ চৌধুরী উলানিয়া হাই স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে  ১৯৬৩ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্ম জীবনের শুরুতে কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে ছিলেন ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। এরপর ঢাকায় গিয়ে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিল্প সাহিত্য বিষয়ক পাক্ষিক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘প্রচ্ছদ’ পরিচালনা ও উপস্থাপনা করতেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি ভয়েজ অব জার্মানীর বাংলাদেশ সংবাদদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর বাংলা একাডেমিতে চাকুরি করে পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আসাদ চৌধুরীর পদচারণা। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- তবক দেওয়া পান (১৯৭৫), বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬), প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৬), জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২), যে পারে পারুক (১৯৮৩), মধ্য মাঠ থেকে (১৯৮৪),  মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫), আমার কবিতা (১৯৮৫), ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৫), প্রেমের কবিতা (১৯৮৫), দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭), নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২), টান ভালোবাসার কবিতা (১৯৯৭), বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮), বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কবিতা-সমগ্র (২০০২), কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩), ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)।

সুলেখক আসাদ চৌধুরী ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর জন্মদিনে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তিনি শতায়ু হোন এই কামনা করি।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী। সাংবাদিক, কবি কথাসাহিত্যিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর