অরণ্যে-মাজারে-মন্দিরে

, শিল্প-সাহিত্য

সাঈদ চৌধুরী | 2023-08-30 10:31:31

সৌরভ অন্যদের নিয়ে হাটে গেছে। আমি আর মনু পাগলা নীলাচল পর্বতে কামাক্ষা ঘুরে দেখলাম। এই মন্দিরে রয়েছে ৪টি কক্ষ। এটি পঞ্চরথ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। ১ম কক্ষটি একটি ভূগর্ভস্থ গুহা। এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু পাথরের সরু গর্ত দেখা যায়। অন্য ৩টি কক্ষে মণ্ডপ। চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির। এগুলির স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সাথে সাদৃশ্য আছে। খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্য ভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মিত খোদাইচিত্র সমৃদ্ধ। মন্দিরের চূড়াগুলি মৌচাকের মতো দেখতে।

ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতটি বেশ সুন্দর। তবে বাংলাদেশের বান্দরবন জেলার নীলাচল তার চেয়ে অনেক মনোরম। শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে টাইগার পাড়ায় নীলাচল পর্যটন কমপ্লেক্স। এটাকে বাংলার দার্জিলিং বললে অত্যুক্তি হবে না। এতে রয়েছে শুভ্রনীলা, ঝুলন্ত নীলা, নীহারিকা এবং ভ্যালেন্টাইন পয়েন্ট নামে পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় বিশ্রামাগার। বাচ্চাদের খেলাধুলা এবং বসার ব্যবস্থাও রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬শ ফুট উঁচু এই জায়গায় বর্ষা, শরৎ ও হেমন্ত সব ঋতুতে মেঘ ছোঁয়া যায় ।

সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে। কামাক্ষা থেকে নিচের দিকে অপূর্ব লাগছে। মহান স্রষ্টা আকাশে যেন জবা লাল চাঁ‌দোয়া টাঙ্গিয়েছেন। পশ্চিম থেকে পূবের দিকে সূর্যের হালকা রঙ ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। অদূরে আরেকটি বড় গাছের নিচে একটি মাজারের মত মনে হল। বিশাল ছায়াবৃক্ষের ঘন চাঁদোয়া, নিচের বর্ধনশীল উদ্ভিদ আলো অবরোধ করে রেখেছে। তবুও সেখানে মানুষের পদচারনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভাবলাম এক নজরে সেটাও দেখে যাই।

পাহাড়ের পাদদেশে অনেকটা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়েছে অশ্বত্থ গাছ। শত বছরের পুরনো এই গাছের ছ়ড়ানো ডালপালা ও পাতায় ঘেরা সামিয়ানার নিচে হুজুর বেশে একজন বসে আছেন। আর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে এসে মানত করছে। ছোট্ট একটি সাইনবোর্ডে লেখা ঘোড়াশাহ মাজার। উপরের মন্দিরের সাথে এটি যেন একেবারে হাত-ধরাধরি করে রয়েছে। মন্দিরে যারা পুজো দিতে আসেন, মাজারেও সিন্নি চড়ান।

হুজুরকে মাজারের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ঘোড়াশাহ এক দরবেশ ছিলেন। বাঘ ভাল্লুকের সাথে জঙ্গলে বসবাস করতেন। অনেক অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তার। এভাবে বেশ ভৌতিক গল্প শুনালেন তিনি। তার নাম আশিক মোল্লা। ফ্যাকাশে মুখ ও দু'চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, কাহিনী গুলো একেবারেই বানোয়াট। এই ব্যবসার প্রতিষ্ঠাতা তিনি। মনু পাগলার সাথে তার বেশ সখ্যতা আছে। মনে হল অর্থনৈতিক যোগসাজসও রয়েছে।

আশিক মোল্লা বললেন, তার বাড়ি নোয়াখালি। বড় হয়েছেন চট্টগামে। অনেক দিন ছিলেন বদর শাহ মাজারে।

চট্টগামে বদর আউলিয়ার দরগাহ সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনা গুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি নগরীর বকশির হাট এলাকায় বদরপাতি রোডে অবস্থিত। বদর পীরের চাটির কথা চট্টগ্রামে আজো কিংবদন্তি। বদর শাহের চাটি থেকে চাটিগ্রাম হয়ে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।

ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ চট্টগ্রাম জয় করার আগেই ইসলাম প্রচারের জন্য সুদূর আরব থেকে হযরত বদর শাহ চট্টলায় আসেন। বলা হয়, পাথরের বুকে চেপে সাগর পাড়ি দিয়ে এই অঞ্চলে পৌঁছেন তিনি। বদর শাহ প্রথম চট্টগ্রামে চেরাগ জেলে শহরের গোড়াপত্তন করেন। তাঁর স্মৃতি বহন করছে মোমিন রোডস্থ 'চেরাগী পাহাড়'।

হোটেলে ফেরার আগে মনু পাগলা আমাকে খাওয়াতে চাইল। ভীষণ নাছোড় বান্দা। না খেলে মানবে না। রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের হোটেল থেকে পায়ে হেটে দশ মিনিটের রাস্তা।

অনেকটা পাহাড়ের গুহায় তার বাড়ি। সুন্দর ও চিমচাম। আমরা বসলাম প্রশস্ত মার্বেল পাথরে সাজানো সিটিং রুমে। বিপরীত দিকে একটা বড় গোদাম ঘর। বড় ঘর মানে আলো-বাতাস ঢুকার মত দরজা-জানালা সমেত ষোল দোয়ারের ঘর। অঢেল খাদ্য সামগ্রীতে ভরপুর। সুষম বা ব্যালান্সড খাদ্য ব্যবস্থা। বিলেতের টেসকো-সেইন্সবারি-আজদার মত মিনি সুপার স্টোর। একেবারে আশ্চর্য হবার মত।

খাবারের টেবিলে বাহারি আয়োজন দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। পুরান ঢাকার নানা রকম সুস্বাদু খাবার। ফুচকা-চটপটি থেকে শুরু করে ফ্রায়েড রাইসের সাথে তান্দুরি চিকেন, কাচ্চি বিরানী সহ হরেক রকম খাবার ঝটপট গরম গরম পরিবেশন করল। ধীরে ধীরে নিজের জীবনের কথাও বলতে লাগল কামরুজ্জামান ওরফে মনু পাগলা।

ঢাকার ছেলে কামরুজ্জামান। বাবার অনেক সহায় সম্পত্তি ছিল। এরশাদ আমলে রাজনৈতিক দ্বন্দের কারনে পাড়ায় একটা খুন হন। এই মামলায় সে প্রধান আসামী। অনন্যোপায় হয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালায়। করিমগঞ্জে তাদের পূর্ব পুরুষের বাড়ি ছিল। এখন সেখানে আর কেউ নেই। কিছু দিন গৌহাটিতে একটা দোকানে কাজ করেছে। বেতনে পুসায় না। তখন এই আশিক মোল্লার সাথে পরিচয় হয়। তিনিও আরেক জায়গায় কাজ করেন।

দুজনে অনেক আলাপ আলোচনা করে স্থানীয় একজনের সাথে ব্যবসা শুরু করেন। পশ্চিম অসমে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে তাদের দোকান। লোহা দ্বারা তৈরী ধাতব অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি বিক্রি করেন তারা। জাহাজের অকেজো বা বাতিলকৃত লোহা-লক্কর, পাওয়ার টিলারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, কৃষির জন্য ব্যবহৃত ফলা, শ্যালো মেশিনের পার্টস, পানি সেচের জন্য যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। মেঘালয় অঙ্গরাজ্যের সীমান্তের কাছে জমজমাট ব্যবসা। জায়গাটি উত্তর পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার বলা যায়। এখানেই রয়েছে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়।

গুয়াহাটি একটি শিল্প শহর। গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দর এবং অসমের বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ১৯শ শতকে গুয়াহাটি সাময়িকভাবে বার্মার অধীনে ছিল। ১৮২৬ সাল থেকে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনাধীন অসমের রাজধানী ছিল। গুয়াহাটিতে ৮ লক্ষেরও বেশি লোক বাস করেন। এখানে পাট, তুলা, চাল এবং চায়ের বাজার আছে। এখানকার কল-কারখানার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভোজ্য তেল পরিশোধন, সাবান ও কাঠ উৎপাদন, বস্ত্র বয়ন এবং ময়দা পেষার কল।

রহস্য, রোমাঞ্চ আর পৌরাণিক গল্পগাথায় পূর্ণ কামরূপে কয়েক বছর বসবাস করে মনু পাগলা ও আশিক মোল্লা নতুন ধান্দা শুরু করে। মাজার কেন্দ্রিক একটি ব্যবসার চিন্তা তাদের মাথায় আসে। একদিন স্থানীয় এক নীরিহ ভদ্রলোক তার অচল প্রায় ঘোড়াটি বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে আসে। আশিক মোল্লা এটা দেখে ধান্দাটি কাজে লাগাতে চায়। মনু পাগলাকে নিয়ে অতি অল্পমূল্যে ঘোড়াটি কিনে নেয়।

এখন যে স্থানটি ঘোড়াশাহ মাজার, আগে সেখানে কিছুই ছিলনা। কামাক্ষা মন্দিরে যাওয়া-আসার একটি গলিপথ এটি। এখানে গাছের নিচে তারা ঘোড়াটি বেধে রাখে। আর গাছের গোড়ার চারদিকে রঙিন কাপড় টাঙ্গিয়ে আশেপাশে ছড়িয়ে দেয় গোলাপ জল ও ধূপ। ঘোড়ার সামনে প্রচুর পরিমান খাবারও রেখে দেয়। পাশে একটি চৌকির উপর তারা দু‘জন দুই দিকে বসে খাদেম বা সেবায়েত হিসেবে। দূর দূরান্ত থেকে আসা লোকজন প্রথমে তাদেরই দাক্ষিণ্য দেয়। তারপর কামাক্ষা মন্দিরে যায়।

প্রতিদিন ভোর বেলায় তারা কিছু খাবার রাখে এবং গোলাপ জল ছিটিয়ে চারিদিকে ধূপ জালিয়ে দেয়। এরপর সারাদিন কামাক্ষা মন্দিরে যাতায়াতকারী অসংখ্য লোক ঘোড়াটিকে প্রনাম করে ও নানা রকমের খাবার ও মানত দিয়ে যায়। রাতের বেলা সেটা তারা বিক্রির জন্য সরিয়ে ফেলে। কিন্তু কিছুদিন পর তাদের ঘোড়াটি মারা যায়। ঘোড়াকে তারা এখানেই মাটি দেয়। তবে লোকজন আর আগের মত আসেনা।

এরই মাঝে শুরু হয় হিন্দু ধর্মের অম্বুবাচী উৎসব। জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, সূর্য যে বারের যে সময়ে মিথুন রাশিতে গমন করে, তার পরবর্তী সেই বারের সেই কালে অম্বুবাচী হয়। ধরিত্রী মা এই সময়ে ঋতুমতী হন। অম্বুবাচীর তিন দিন পর্যন্ত কোনও ধরনের মাঙ্গলিক কার্য করা হয় না। চতুর্থ দিন থেকে মঙ্গলিক কাজে কোনও বাধা থাকেনা।

অম্বুবাচীর সময় হাল ধরা, গৃহ প্রবেশ, বিবাহ ইত্যাদি শুভ কাজ করা নিষিদ্ধ থাকে। এই সময়ে মঠ-মন্দিরের প্রবেশদ্বার বন্ধ থাকে। নিরয়ণ পঞ্জিকা মতে ৭ থেকে ১১ আষাঢ় এই চার দিন গ্রাম-বাংলার মহিলারা এই অনুষ্ঠান পালন করেন। চাষ বাসের কাজ এই সময় বন্ধ থাকে। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে অবশ্য পিঠা-পায়েস তৈরির রীতি আছে।

মনু পাগলা ও আশিক মোল্লা এই সময় ঘোড়াশাহ মাজার নামে একটা সাইন বোর্ড টানিয়ে পিঠা-পায়েস উৎসব শুরু করে দেয়। অম্বুবাচী উৎসবে আসা লোকজন দেদারসে পিঠা-পায়েস খায়। আর দর্শনার্থীরা টাকা-পয়সা সহ হরেক রকম জিনিস দাক্ষিণ্য দেয়। এভাবেই ঘোড়াশাহ মাজারের ব্যবসা জমে উঠেছে। (চলবে)

লেখক: লন্ডন প্রবাসী। সাংবাদিক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর