অরণ্যে-মাজারে-মন্দিরে

, শিল্প-সাহিত্য

সাঈদ চৌধুরী | 2023-09-01 16:52:48

ভাবনার ঘোরে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মন। কামরূপে ঘোড়াশাহ মাজারের কর্মকান্ড দেখে মনের মুকুরে একটা গভীর দূর্ভাবনা কাজ করছে। মনু পাগলার ঘরে খেয়েছি বলেই হয়ত আমার শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। ওলি-আউলিয়ার নামে এমন বিচ্ছিরি কারবার জেনে নিজের মাঝে এক ধরণের অসহ্য যন্ত্রণার সৃষ্টি করে চলেছে। মাংসপেশিতে ব্যথা বা টানটান ভাব হচ্ছে। বুকের ধুকপুকানি-ধড়ফড় শুনতে পাচ্ছি।

আমার অস্বস্তি ও অস্থিরতা মনু পাগলা হয়তো বুঝতে পারছে। সে আমাকে অন্য মনস্ক করার জন্য শাহ জালালের (রহ) মাজারে আমার সাথে তার প্রথম দেখার স্মৃতিচারণ শুরু করে। বেশ প্রফেশনাল সাইকোথেরাপিস্ট বা সাইকোলজিস্টের মত বিষাদ প্রতিরোধক থেরাপি দেয়ার চেষ্টা করছে। দরবেশ শাহ জালাল সহ ধর্মপ্রচারকদের আস্তানায় অধর্ম প্রবেশের আরো গভীর অনুসন্ধানের জন্য মনু পাগলাকে আমার প্রয়োজন। আমিও দ্রুত সামলে নেই নিজকে। স্মৃতি রোমন্থন করি তার সাথে।

সেদিন শিশির ভেজা পথে সুতির পোশাক পরে বেরিয়ে ছিলাম। মর্ণিং ওয়াকের ঝোঁক আমার হামেশাই। ছোট ফুটপাত ছেড়ে খালি রাস্তার মাঝপথে প্রাত:ভ্রমণে গতি পাওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই দরগা গেইট। প্রবেশ পথে আধুনিক কালে নির্মিত পবিত্র কালেমা খঁচিত তোরণ। কয়েক গজ যাবার পর মূল ফটক। দোতলা ঘরের মত সদর দরজা দিয়ে দরগার মূল চত্বর। সোজা চলে যাই ওপরের দিকে।

বড় গম্বুজ বিশিষ্ট হল ঘরের ভেতর দিয়ে মাজারে প্রবেশ করি। চারকোণো উঁচু ভিত্তির ওপর ঘরটি স্থাপিত। হলের চারকোণে চারটি আটকানোকৃতি বরুজ বেশ চমৎকার। হল ঘরের ওপরে এক অভিনব কৌশলে গম্বুজের ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে। ভেতরের অংশটা কারুকাজ খঁচিত। কার্নিশের পেরাপেট তৈরীর কাজে মোগল স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। একটি আরবী শিলালিপিও রয়েছে এখানে।

হলঘর থেকে বেরিয়ে ঘড়িঘর। তিন দিক থেকে তিনটি অর্ধবৃত্ত খিলান ও একটি গম্বুজ বিশিষ্ট। এর পূর্বে চিল্লাখানা। যে স্থানে বসে শাহ জালাল (রহ) আরাধনা করতেন। চিল্লাখানার উত্তর দিকে প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকেই মাজার। কবরের ওপর ইট দিয়ে উচুঁ করে বাঁধানো। চারপাশে চারটি স্তম্ভ। ওপরে চাদোয়া টাঙ্গানো। পাশে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট ছোট মসজিদ। সেখানে বসে অনেকেই পবিত্র কোরআন তেলায়াত করেন। আলাদা ভাবে অবশ্য চারতলা বিশিষ্ট মসজিদ ও মাদ্রাসা রয়েছে।

শাহ জালালের (রহ) কবরের পূর্ব দিকে তাঁর অন্যতম সফর সঙ্গী ইয়ামেনের যুবরাজ শাহজাদা আলীর কবর। মধ্যপ্রাচ্যের একজন প্রিন্স সাথে আসার মাধ্যমে তখনকার সময়ে আধ্যাত্মিকতার পাশাপশি তাঁর সামাজিক অবস্থানও অনুমেয়। এক পরিপূর্ণ সভ্যতা উপহার দেয়ায় মহান এই বুজর্গ ও তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে যায়।

মাজার থেকে দর্শন দেউড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় ঝর্ণার পারে মনু পাগলার সাথে দেখা হয়েছিল। এরপর কতবার দেখেছি। কিন্তু কামরূপ এসে তাকে নতুন করে দেখা ও জানা হল। অনেক কথা বলার পর মনু পাগলা দেশে এলে আমার সাথে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমিও খানিকট আগ্রহ দেখালাম। ইতোমধ্যে আমার ট্যুর আপরেটর সৌরভের সাথেও তার বেশ খাতির জমেছে।

মনু পাগলা ও সৌরভ মিলে মাজার ও মন্দির কেন্দ্রিক অনেক কাহিনী শোনায়। এরপর বেশ কটি জাদুবিদ্যা কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সবশেষে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় দেখার প্রস্তাব দেয়। কোন রকম বিলম্ব না করেই যাত্রা করি সেখানে। এটি ভারতের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উত্তর পূর্বাঞ্চলের অগ্রগামী বিশ্ববিদ্যালয়। অসমের রাজধানী গুয়াহাটি শহরের জালুকবারী নামক স্থানে অবস্থিত। কামাক্ষা রেল স্টেশন থেক ৫ কিলোমিটার দূরত্ব। এই বিশ্ববিদ্যালয় ৩৭নং রাষ্ট্রীয় ঘাইপথ দ্বারা সংযুক্ত। এখানে ৩০০০ ছাত্র-ছাত্রী থাকার জন্য আবাস গৃহ এবং শিক্ষার্থী ও কর্মচারী থাকার জন্য সুব্যবস্থা আছে। অসমের উন্নত শিক্ষা ও রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা বিভাগে ২১টি ও বিজ্ঞান বিভাগে ১৬টি সহ ইংরেজি বিভাগ, আরবি বিভাগ, পার্সি বিভাগ, বাংলা বিভাগ এমনকি পেট্রলিয়াম প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগও রয়েছে। সেখানে বিশাল গ্রন্থগারটিতে ২৫৯৪৯০টি গ্রন্থ সংগৃহিত আছে। ১০২২১২টি গ্রন্থবদ্ধ সাময়িকী, ২২৫০টি গবেষণা গ্রন্থ, ৬৯০৮টি প্রতিবেদন ও নিবন্ধ এবং ৩০৬টি মানচিত্র পুস্তক অন্তর্গত। এই গ্রন্থাগারে কম্পিউটার দ্বারা গ্রন্থ অনুসন্ধানের সুবিধা আছে। খবরের কাগজ এবং ম্যাগাজিন পাঠ করার ব্যবস্থাও রয়েছে।

গ্রন্থগারে সাক্ষাৎ হল গবেষক ও সমাজ চিন্তক অন্বয় দাসের সাথে। তিনি এই অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে বেশ রসালো আলোচনা করলেন। লাইব্রেরির অনেক তথ্য ও গবেষনা গ্রন্থ থেকে বের করে দেখালেন আমাদের বিশাল বাংলার ইতিহাস।

অধুনা বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকা এক সময় বিশাল বাংলা ছিল। বিগত চার সহস্রাব্দের ইতিহাসে এই বাংলার ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গঙ্গা ও ব্রম্মপূত্র নদ বাংলাকে ভারতের মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে বাংলা সর্বদাই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পারস্য, আরব এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সাথে বাংলার দৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।

বাংলা বিভিন্ন সময়ে আঞ্চলিক শাসকদের রাজধানী রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। ৮ম থেকে ১১ শতকে বৌদ্ধ শাসক পাল আমলে এবং ১১ থেকে ১২ শতকের হিন্দু শাসক সেন আমলে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। ১৩ শতাব্দীর পর এই অঞ্চল মুসলমান সুলতান বারো ভুইয়া দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ১৬ শতকের শেষে এবং ১৭ শতকের শুরুতে ঈশা খা বারো ভূঁইয়াদের নেতৃত্ব দেন। দিল্লীর সুলতানাত এবং শাহী বাংলার সুলতানদের সময় ইউরোপবাসী বাংলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বাণিজ্যিক দেশ রূপে গণ্য করত।

মুঘল আমলে বাংলা ছিল সবচেয়ে সম্পদশালী প্রদেশ। মুঘল আমলে সুবাহ বাংলা সমগ্র সাম্রাজ্যের শতকরা ৫০ ভাগ জিডিপি‘র যোগান দিত। বাংলা সমুদ্রগামী জাহাজ ও বস্ত্র শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) ১২ শতাংশ উৎপন্ন হত সুবাহ বাংলায়। যা সে সময় সমগ্র ইউরোপের মোট দেশজ উৎপাদনের চেয়ে অধিক ছিল। ক্রমে মুঘল শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে, মারাটা আক্রমনের পর বাংলায় প্রায়-স্বাধীন নবাবদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর বাংলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে চলে যায়। ১৮ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ব্রিটিশরা সমগ্র বাংলার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ ও ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধের পর কোম্পানি বাংলায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

বাংলায় ব্রিটিশদের লুণ্ঠনক্রিয়া তৎকালীন ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলা থেকে নিয়ে আসা পুঁজি ব্রিটেনের বিভিন্ন শিল্পে, বিশেষ করে বস্ত্র শিল্পে বিনিয়োগ করে, ব্রিটিশরা প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়েছিল। একই সাথে, এই লুণ্ঠনের ফলে বাংলায় শিল্পায়ন ব্যাহত হয় এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৪৭সালে ভারত পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময়ে বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। বাংলার পশ্চিম অংশ ভারতের একটি রাজ্যে পরিণত হয়। পূর্ব অংশ যুক্ত হয় পাকিস্তানের সাথে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।

প্রাণবন্ত আলোচনায় বাংলাকে নিয়ে এক ধরনের নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে আমাকে। সমৃদ্ধ বাংলার কল্পনার আবেশে কখন যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলি। হঠাৎ বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি সূর্যটা অস্তগেছে, আঁধার নেমে এসেছে ধরণীতে। বেলা শেষে পাখিরা যেমন নীড়ে ফেরে, আমরাও তড়িঘড়ি হোটেলে ফিরে আসি। এরি মাঝে রাতের আকাশ ঝলমল হয়ে ওঠে রূপালী চাঁদের আলোয়! (চলবে স্মৃতির ডাইরি থেকে)

লেখক: লন্ডন প্রবাসী। সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর