৫২ বছর পর পুনঃপ্রকাশিত ড. মনিরুজ্জামানের গল্পগ্রন্থ

, শিল্প-সাহিত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 10:39:47

 

বৃহৎ বাঙালি সমাজের নৈতিক আদর্শবাদী যুগের শেষ প্রতিনিধি এবং রোমান্টিক যাপনের অন্তিম জাতক ড. মনিরুজ্জামান, বরিষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী, পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক জনপদ আদিয়াবাদ, রায়পুরা, নরসিংদীর সন্তান, জন্ম (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০) ও শৈশব কাটিয়েছেন অখণ্ড বঙ্গদেশের পশ্চিমাংশে। ৫২ বছর পর পুনঃপ্রকাশিত হলো ড. মনিরুজ্জামানের গল্পগ্রন্থ 'পুরুষ পরম্পরা'।

ড. মনিরুজ্জামান কর্মসূত্রে ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সাগর-মিথিলা ভূমির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ ভারত ও বিলাতের নামজাদা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থেকে অকাতরে আহরণ করেছেন তাত্ত্বিক ও ফলিত জ্ঞান, যা ভাষা, সাহিত্য ও ফোকলোর বিষয়ে ৩৫টি বই ও শতাধিক গবেষণা প্রবন্ধে বিবৃত।

'পুরুষ পরম্পরা' তাঁর একমাত্র গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। প্রকাশনা-শিল্পে ৭০ বছরের ঐতিহ্যস্নাত 'স্টুডেন্ট ওয়েজ' কর্তৃক অর্ধ-শতাব্দী পর গ্রন্থটির পুনঃপ্রকাশ বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক ঘটনা। 'স্টুডেন্ট ওয়েজ' পরিচালক মোহাম্মদ মাশফিকউল্লাহ তন্ময় জানিয়েছেন যে, বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাসমূহ অব্যাহতভাবে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া তাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে, 'পুরুষ পরম্পার'র মতো সুদীর্ঘ বছর জাগ্রত থাকার সৌভাগ্য খুব কম বইয়ের ভাগ্যেই জুটেছে। পনেরটি সুডৌল গল্পে মেদহীন, বাহুল্যবর্জিত ভাষায় অঙ্কিত হয়েছে জীবনের খণ্ড-বিখণ্ড আখ্যান। যদিও আদর্শবাদ প্রধান উপজীব্য, তথাপি আর্থ-সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে শ্লেষ, কৌতুক, বিদ্রূপ আর জীবনসংগ্রামের লুক্কায়িত উপাখ্যান উন্মোচিত করেছে গল্পগুলো। সমকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রবীণতম শিক্ষাবিদের গল্প কাঠামো, শৈলী, আঙিক, উপমায় নিজস্ব ঘরানার নির্মাতা এবং অবশ্যই বাংলা কথাসাহিত্যের শিল্পিত সম্পদ।

ড. মনিরুজ্জামানের গল্পে নিরীক্ষা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে স্বকীয় ভাবনার বুনন। মানুষ, জীবন ও জগতের প্রপঞ্চগুলোকে তিনি বীক্ষণ করেছেন নিজস্ব ভাষার ব্যাঞ্জনায়, বিন্যাসে ও স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে। তাঁর গল্প সংখ্যায় অত্যল্প হলেও চৌম্বকীয় শক্তিতে পাঠককে টেনে রাখার শক্তিমত্তায় ভরপুর।

একজন অগ্রণী গল্পকার মূলত একজন নিবিষ্ট অন্বেষক ও গবেষক। চলমানতার অন্তস্থঃতলের অধ্যয়নে দৃষ্টিভঙ্গির বহুমাত্রিকতায় তাকে হতে হয় পারঙ্গম। সাধারণ চোখ যা দেখে না, অচল মন যা বুঝে না, স্থবির চিত্ত যা অনুভব করে না, গল্পকার সেসব করে দেখান কথামালার শিল্পসম্মত প্রযুক্তিতে এবং চরিত্র বা ঘটনার মূলবিন্দুর প্রক্ষেপে। ড. মনিরুজ্জামান বাংলা ছোটগল্প সফল নিমার্ণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট শর্তাবলীর সক্ষম প্রয়োগের মাধ্যমে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যে, গল্পগুলো সম্পূর্ণত তার এবং অন্য কারো মত নয়। এমন আদর্শ স্থাপনের কৃতিত্ব শিল্পীজীবনের চরমতম সফলতার অনুষঙ্গ।

জীবনব্যাপী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিপুষ্টি সাধনের ব্রতে নিয়োজিত একজন ধ্যানী ও আত্মনিবেদিত সাধকের বিনির্মাণে গল্পগুলো স্বর ও ব্যাঞ্জনায় মুখরিত করে পাঠকচিত্ত এবং ছুঁয়ে যায় রত্নাবলীর বিচ্ছুরিত দ্যেতনায় আর সমৃদ্ধতর করে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর