মাহফুজ পারভেজের গুচ্ছ কবিতা

, শিল্প-সাহিত্য

মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-30 17:53:16

আকর্ষণ-বিকর্ষণ-অবসেশন

'আকর্ষণ' কত দূর অবধি গেলে শুধুই 'আকর্ষণ' থাকে?
কিংবা কত দূর চলে গেলে 'অবসেশনে' পরিণত হয়?

'অবসেশন’ ও 'আকর্ষণ'-এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা না জেনেও
আকর্ষণ-বিকর্ষণ-অবসেশন ছুঁয়ে ছুঁয়ে
মানুষ মানুষেরই কাছে আসে
আবার মানুষের চেয়ে বহুদূরে চলে যায়:

কখনো একা
কিংবা যৌথতায়
মানুষের আসা-যাওয়া
আকর্ষণ-বিকর্ষণ-অবসেশনের জোয়ার-ভাটায়
চলে, চলতে থাকে
বিরামহীন প্রক্রিয়ায়।।

সেইসব সঙ্কুল পরিস্থিতিতে মানুষ রবীন্দ্রনাথের অনুকরণে গায়:
“যদি আর কারে ভালবাসো
যদি আর ফিরে নাহি আসো
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও
আমি যত দুঃখ পাই গো”

জনম জনম

রাত ও জনম চলে যায় আর তারা হেঁটে যেতে চায়
মানুষ তো হেঁটে হেঁটে যেতে চায় রাতের শরীর থেকে জন্ম নেওয়া ভোরে।

ফরিদপুর থেকে নড়াইল খুব দূরে নয়
হেঁটে হেঁটে তারা দেখা পায় পরস্পরের, কলকাতায়
একজন সুর করে আরেকজন গায়:
“কত জনম যাবে
কত নিশি হবে ভোর
বলো চাঁদের লাগি
কত ঝরিবে চকোর।”

কিছুই জানে না, কিছুই পায় না
তবু তারা একজন আরেকজনের খোঁজে হাঁটতেই থাকে
তারপর আত্মজিজ্ঞাসায় গুঞ্জরিত করে:
“শুধু নিজেরে লয়ে
দিন যাবে কি বয়ে
যদি ধরা না দেবে
কেন দিলে ফুলডোর।”

হাঁটতে হাঁটতেই তারা টের পায়:
“এই বিরহ মম
বুঝি নিয়তি লেখা
তাই মিলন মাঝে
আজও দু'জনে একা।”

জীবনের বহু লেনদেন সেরে হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে আসে, ঢাকায়
উপলব্ধির অনলে ঋদ্ধ হয়ে উচ্চারণ করে:
“কেন বুঝিলে না হায়
মোর হিয়া কারে চায়
কেন আঘাত সহে
এই ভালোবাসা মোর।”

ভালোবাসার জন্য এমন ঘোরতর হেঁটে যাওয়ার আরেক নাম
ফিরোজা বেগম
যার কণ্ঠের সমান্তরালে সুরের ইন্দ্রজাল কমল দাশগুপ্ত।

নিয়তি

বারান্দার গ্রিলে কাঁটাতারের ঘেরাটোপ:
ভূতুড়ে অন্ধকার
ম্লান চাঁদ দূরের দিগন্তে আমার মতো একা।
আমি পড়ছি সেই চিঠি
হাতে ঘুমন্ত সঙ্গীন
স্মৃতিতে বাঙ্কার
চিঠিতে কম্যান্ডারের অক্ষর
যুদ্ধ কিংবা শান্তির পাঠোদ্ধার করার নিয়তি আমাকে ছোবল দিচ্ছে।

আমি দৃশ্যমান শত্রুর ছায়া পেরিয়ে
ভয়ংকর অদৃশ্য-শত্রুর মুখোমুখি।
কখন যুদ্ধ হবে, জানি না
জানি, কাউকে না কাউকে মরতে হবে রণাঙ্গনে।

ফ্রন্টগুলো ভীষণ ব্যস্ত এখন
পাগলের মতো মজুত করছে আত্মরক্ষার কৌশল
অনির্দিষ্টকালের খাবার জমছে সেনাছাউনিতে।
ভিড়ের রাস্তাঘাট ফাঁকা
সুন্দর শহর প্রেতপুরী
সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় ভয়
কারো জানা নেই
পালিয়ে যাওয়ার পথ।

একলা একটি ছোট্ট মেয়ে
আমার মতোই জানলার গরাদে আটকে
খুঁজছে জীবন
দেখছে, ভিনদেশি শ্রমিকের দল চলে গেছে
বাদকেরা সুরের প্রতিধ্বনি রেখে ফিরে গেছে
অস্থির যুবক-যুবতীরা মৌন
গল্প কবিতায় ঢেউ থেমে গেছে
কোথাও নেই প্রাণ ও স্পন্দন।

যা ছিল তা আর নেই
সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে
ওষুধের দোকানে লম্বা লাইন
হাসপাতালে ভিড়
উৎসবের পাশে আলোর ফোয়ারা
চুপচাপ সবাই বসে আছে স্থির, অন্ধকারের পাশে।

সবার অলক্ষ্যে কংক্রিটে জমেছে কিছু শিশির
নিয়তির মতো একা:
আমি হাত বাড়িয়ে দিই
আমার আঙুলে জলস্পর্শ
কণ্ঠে হিমকুয়াশার গান
আমি চিরতরে হারিয়ে যেতে চাই প্রাচীন উদ্যানে।

কান্না

কান্না কখনো সজীবতা নিয়ে আসে
জড়তা জড়ানো পত্র-পল্লবেও আসে কখনো কখনো
বরফশীতল গানে
অন্তরের শূন্য উঠানে
কান্নার আগত ক্যারাভান
বোধের সীমান্তে উড়ায় রূপালি আঁচল।

কেউ হেঁটে যেতে চায় না কান্নার কাছে
আলো, অন্ধকার, পৃথিবীর প্রভাত
পেরিয়ে একান্ত শূন্যতার কাছে।
কেউ কেউ রেখে আসে
অশ্রুমোচনের ঋণ
মৃত্তিকার স্মৃতি
নদীজল
পলাতক স্রোত ও ঘূর্ণি।

চোখের দর্পণে যাযাবর মেঘ ভাসিয়ে
মানুষ কান্নার জন্মান্তর দেখে
তথাপি কেউ হেঁটে যেতে চায় না কান্নার কাছে
বরং কান্নাকে পাশে নিয়ে হাঁটে।

জীবনের অবাক বিবরে কান্নার কুঁড়ি
লিখে রাখে অশ্রুজল মানুষেরই নিকট-দূরত্বে।

ক্যামেরা

অন্যের ক্যামেরায় তোমাকে দেখতে দেখতে
আমি হারিয়েছি বসন্ত-বাহার, বকুলগন্ধ।
অন্যের অক্ষরে তোমাকে পড়তে পড়তে
আমি জীবনকে বুকসেলফে খুঁজে পেয়েছি।

স্টাডিরুমের জানালায় রেললাইন, ধোঁয়ার কুণ্ডলী
ধুসর দিগন্ত আর ছায়াসকাল:
হাতের মুঠোয় তোমার কাছে যাবার পথনির্দেশ নিয়ে
আমার প্রতিজ্ঞা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে।

হাতে বই, চোখে ক্যামেরা নিয়ে
এক প্রহেলিকা থেকে অন্য অন্ধকারে
অন্ধকার থেকে চন্দ্রলোকে পা ফেলে ফেলে
ছায়ায় মায়ায় নিজের স্বপ্ন খুঁজছি আমি।

আকাশে যুগল শালিখ উড়ল গোপন কথাদের ভিড় ছেড়ে
আমার নয়নপথে ক্যামেরা, বইয়ের অক্ষর, তোমার অন্বেষা।

শহরতলি

শহরতলির মেয়ে বলে কেউ আজ আর নেই
সবাই কসমোপলিটন।
নগরীর ধুলো গন্ধ ছেড়ে
কোনো পথ আর গ্রামে যায় না।
ফুটপাথ দখল করে আগ্রাসী শহরগুলো ছড়িয়ে গেছে
গ্রামের অলিন্দে
শহরতলির মেয়ের ঠিকানায়:
স্মৃতির মানুষ ও জনপদগুলো দখলে ধ্বস্ত আজ।

দেখি, স্মৃতিঘরের চৌকাঠে শুয়ে আছে পুরনো ছায়াপথ
লাজুক প্রহর
অস্নাত অঘ্রাণের সৌরভ
ঋতুপরবের দিন।

সোনারোদে মিশে দূরের হাওয়ায়
ফাগুনের সুরে বেঁধেছিলে যে দরদি কৈশোর বেলা
এখন প্রতিদিনের পড়ন্তবেলায় বিভ্রম উড়ে যায়
বিশ্বায়নের দূরের আকাশে।

পথ ভেঙে কতদিন যেতে চেয়েছি প্রিয় চেনা ভুবনে
স্মৃতির জোয়ার-ভাটার
মগ্ন কিনারায়
হারানো শহরতলিতে।
কেউ পথ দেখায় না,
পথ হারিয়ে দেয়
বিস্মিত জীবনের বাঁক
সাঁঝবাতির বানোয়াট আলো:

পৃথিবী শহরতলিহীন নিঠুর তেপান্তর
ঠাসাঠাসি, দমবন্ধ, স্মৃতিবিহীন, প্রকৃতিবিনাশী।

আইসোলেশন

কথাটা কেউ কাউকে বলি নি
বলা হয় নি
তার আগেই আমরা প্যান্ডামিক তাণ্ডবে ভেসে গেছি
আইসোলেশন ক্যাম্পে।

এখন অপেক্ষা।
কখন বাজবে প্রাণের সাইরেন
জ্বলবে সবুজ আলো
খুলবে যোগাযোগের সমস্ত বন্ধ রাস্তা।

একটা নির্জন গাছের নীচে দাঁড়িয়ে
হয়তো ভিজবো দিনের পর দিন অপেক্ষার বৃষ্টিতে, একা।
ভাববো, কখন গুটিয়ে নেবে ক্যাম্প
হয়তো তখন মনে হবে কথাগুলো বলা হয় নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর