অনন্য সাধক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক

, শিল্প-সাহিত্য

ড. মহীবুল আজিজ | 2023-09-01 01:56:11

আমার শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার ১৪ জুলাই রাত আনুমানিক ১১.৪৫-এ রাজধানী ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী প্রফেসর ড. শরীফা খাতুন, চার কন্যা, দুই ভাই, তিন দৌহিত্রসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও গুণগ্রাহীদের রেখে গেছেন।

মরহুম বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি ফেনি জেলার বালিগাঁও গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী আবদুল হক ছিলেন একজন শিক্ষক এবং সমাজসেবী। তাঁর মাতা হুরেন্নেছা বেগম। ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৫৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৫৫ সালে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতিতে সমর্পিতপ্রাণ তিনি ছিলেন সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনে তাঁর ছিল গৌরবময় ভূমিকা। ফেনি কলেজের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন সে-বছর এবং ভাষা আন্দোলনের দক্ষ সংগঠক হিসেবে ফেনি এবং নোয়াখালি অঞ্চলে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। বলা যায় তখন থেকেই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির কোপানলে পড়েন। এর ফলে তাঁকে অনেক খেসারতও দিতে হয়। পাকিস্তান সরকার তাঁকে কালো তালিকাভুক্ত করে এবং তাঁকে কোনো পাসপোর্ট দেওয়া হয় না। তাঁর স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ইন্সটিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ড. শরীফা খাতুন যখন ১৯৬৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত থাকেন তখনও স্বামী হিসেবে তাঁর বিদেশ গমনের সুযোগ থেকে পাকিস্তান সরকার তাঁকে বঞ্চিত করেছিল।


তথাপি জনাব কাজী এবাদুল হক তাঁর অঙ্গীকার থেকে পিছু হটেন না। ভাষা-আন্দোলন পরবর্তী-পর্ব ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের একজন প্রত্যক্ষ কর্মী হিসেবে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫৯ সালে ফেনি মহকুমা আদালতে আইনপেশায় নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৬৫-তে জেলা আদালতে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে আইনপেশায় যোগ দেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে খ্যাতি ও সুনামের সঙ্গে আইনপেশায় নিয়োজিত থাকেন। বিখ্যাত আইনজীবী এস আর পাল (সবিতা রঞ্জন পাল) এবং বীরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর সঙ্গে একযোগে তিনি বহু বিখ্যাত মামলা পরিচালনা করেন।

১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে আরম্ভ করেন। ২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হ’ন তিনি এবং সেই পদে থাকাকালে একজন সচেতন নাগরিক এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে কৃতিত্বপূর্ণ  স্বাক্ষর রাখেন। উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক এদেশের ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, রায়টি তিনি দিয়েছিলেন মাতৃভাষা দিবসের মাস ফেব্রুয়ারিতে।  বিশেষ করে একটি প্রচলিত ধারণা ছিল ইংরেজির পরিবর্তে উচ্চতর আদালতে বাংলায় রায় দেওয়া সম্ভবপর নয়। বস্তুত এক ধরনের উন্নাসিকতা ও উপনিবেশসুলভ মানসিকতা থেকেই দীর্ঘকাল এহেন ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল। কাজী এবাদুল হক সে-ধারণাকে শুধু মিথ্যেই প্রমাণ করেন নি, বরং পরবর্তী প্রজন্মকেও বাংলা ভাষায় রায় প্রদানে অনুপ্রেরণা যোগান। ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকা পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে আইনবিষয়ক লেখালেখিতে তিনি মনোনিবেশ করেন নিষ্ঠা-একাগ্রতার সঙ্গে। বিচারব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কিত তাঁর গ্রন্থ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ সৃষ্টি ‘নজিরসংহিতা’ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় এবং সর্বমহলে প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় আইন বিষয়ক লেখালেখিতেও তিনি ছিলেন সমান নিবেদিত। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘এ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব জাস্টিস’।

পারিবারিক-সামাজিক জীবনেও তিনি একজন সফল মানুষ হিসেবে পরিগণিত। তাঁর স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ইন্সটিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও পরিচালক প্রফেসর ড. শরীফা খাতুন ২০১৭ সালে  বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। ড. খাতুনও বাংলা ভাষায় শিক্ষা, শিক্ষা ও দর্শন, তুলনামূলক শিক্ষা, শিক্ষা ও অস্তিত্ববাদ প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া প্লেটোর ‘কাল্লিপলিস’ অনুবাদে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

উল্লেখ্য, জনাব এবাদুল হক এবং ড. খাতুন দু’জনেই রচনা করেন স্ব-স্ব আত্মজীবনী যেগুলো বাংলাদেশের ইতিহাস ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলনও বটে। বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের প্রথম কন্যা, আমার স্ত্রী প্রফেসর ড. কাজী শামীম সুলতানা বর্তমানে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে কর্মরত। এর আগে তিনি ১৯৯০ সাল থেকে ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় কন্যা ড. কাজী সাবেরা সুলতানা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ড. সাবেরা’র স্বামী প্রফেসর ড. জোসেফ কান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কর্মরত। তাঁর তৃতীয় কন্যা ড. কাজী ইফফাত হক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ‘ইন্টেল’ সংস্থায় কম্প্যুটার-বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ড. ইফফাতের স্বামী ড. বদরুল মুনীর সারওয়ারও একজন কম্প্যুটারবিজ্ঞানী এবং বিশ্বখ্যাত ‘স্যল প্রাইজ’ লাভকারী একজন বিজ্ঞানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের চতুর্থ কন্যা বিচারপতি ব্যারিস্টার কাজী জিনাত হক বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে কর্মরত আছেন।

ইতোপূর্বে প্রথমে আইনপেশায় এবং পরে এ্যাসিস্টেন্ট এবং ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে সুনামের সঙ্গে বিচারবিভাগে দায়িত্ব পালন করেন।

উল্লেখ্য, পিতা কাজী এবাদুল হকের মত তিনিও আইনবিষয়ক লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছেন এবং এরিমধ্যে পিতা ও কন্যার যৌথ গ্রন্থ পাঠক-সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

মরহুম বিচারপতি কাজী এবাদুল হক এক বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করেছেন যে-জীবন পরহিত এবং স্বদেশচেতনায় ভাস্বর। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর কৃত কর্মের মূল্যায়ন অনুপ্রাণিত করবে নতুন প্রজন্মকে।

১৫ জুলাই ২০২২

ড. মহীবুল আজিজ, সাবেক ডিন ও অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; কবি-কথাশিল্পী-লেখক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর