বিদায় গজলসম্রাট, ময়মনসিংহের জামাতা ভূপিন্দর সিং

, শিল্প-সাহিত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 21:40:55

 

ভারতীয় পাঞ্জাবের রাজকীয় শহর পাতিয়ালার সঙ্গীত ও সংস্কৃতির আবহে ১৯৪০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম হয় এক শিল্পীর। বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুর নদের জলকল্লোল মন্দ্রিত কণ্ঠের অধিকারী আরেক শিল্পীর সঙ্গে গান ও জীবনের মিতালী রচনা করেন তিনি। সুরের ইন্দ্রজালে আরব সাগরের তীরের বোম্বেতে অতিবাহিত করেন তারা এক যৌথ নান্দনিক যাপন।

১৮ জুলাই সোমবার তাল কাটলো সেই সঙ্গীতমুখর মিলিত জীবনের। বার্ধক্যজনিত একাধিক সমস্যায় ভুগছিলেন বর্ষীয়ান শিল্পী। একাধিকবার মূত্রনালীর সংক্রমণে ভুগেছেন। তদুপরি, করোনায় আক্রান্ত হয়ে হৃদরোগ সমস্যায় মৃত্যু হয় ভূপিন্দর সিং-এর। স্ত্রী মিতালী মুখার্জি সিং হন দোসর-হারা পাখির মতো নিঃসঙ্গ ও একেলা।

ইউরিনারি সমস্যা নিয়ে ক্রিটিকেয়ার এশিয়া হাসপাতাল ভর্তি হন। সেখানকার ডা. দীপক নামজোশির বয়ান অনুসারে, “ভুপিন্দরজিকে দশ দিন আগে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তার সংক্রমণ হয়েছিল। আমাদের দৃঢ় সন্দেহ ছিল যে তার কোলন সমস্যা আছে এবং আমরা তদন্ত করছিলাম। একই সময়ে তার কোভিড-১৯ও পাওয়া যায়। সোমবার সকালে তার অবস্থার অবনতি হয় এবং আমাদের তাকে ভেন্টিলেটরে রাখতে হয়। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে প্রয়াত হন”।

ভূপিন্দর সিং আর মিতালী মুখার্জি সিং উপমহাদেশের গানের জগতকে সুর-লহরীর দ্যোতনায় মাতিয়েছেন দশকের পর দশক। যুগলবন্দী ছিন্ন করে চলে গেলেন ভূপিন্দর সিংহ। বয়স হয়েছিল তার ৮২ বছর। বলিউড সঙ্গীত দুনিয়ার কাছে তিনি গজল সম্রাট নামে খ্যাত। রেখে গেছেন তিনি বাংলা, হিন্দি ভাষায় অজস্র গান।

তার বিখ্যাত গানগুলির মধ্যে রয়েছে, ‘এক অকেলা ইস শহর মে’, ‘নাম গুম যায়েগা’, ‘দিল ঢুন্ডতা হ্যাঁয় ফির ওয়াহি’ ইত্যাদি। মিঠুন চক্রবর্তী, দেবশ্রী রায় অভিনীত ‘ত্রয়ী’ ছবিতে ভূপিন্দরের গাওয়া, ‘কবে যে কোথায় কী যে হল ভুল’ আজও এই প্রজন্মের প্রিয়। তার ভারী কণ্ঠস্বরের নরম সুরে ‘মৌসম’, ‘সত্তে পে সত্তা’, ‘আহিস্তা’, ‘দুরিয়া’ ছবির গান শ্রোতাদের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।

পাঁচ দশকের গানের ইন্ডাস্ট্রির অসংখ্য মহারথীর সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি। মহম্মদ রফি, আরডি বর্মণ, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে এবং বাপ্পি লাহিড়ির মতো নমস্য শিল্পীদের সঙ্গে তার একাধিক কাজ অবিস্মণীয় হয়ে আছে। গজল জগতের 'সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ' এবং 'সম্রাটের সম্রাট' মেহেদী হাসান এবং অবিস্মরণীয় তালাত মাহমুদ ও সুরেলা গোলাম আলীর ঐতিহ্য বহনকারী রূপে যে তিন পরবর্তী শিল্পীকে গণ্য করা হয় ভূপিন্দর তাদের অন্যতম। বাকী দুইজন হলেন অনুপ জালোটা ও পঙ্কজ উদাস।

গায়িকা স্ত্রী মিতালীর সঙ্গেও ভূপিন্দর সিংয়ের একাধিক বিখ্যাত গান রয়েছে। 'দো দিওয়ানে শহর মে', 'নাম গুম জায়েগা', 'এক আকেলা ইস শহর মে', 'কভি কিসি কো মুকম্মল'-র মতো সুপারহিট গান তিনি উপহার দিয়েছেন।

মিতালী মুখার্জি ময়মনসিংহের অমূল্য কুমার ও কল্যাণী মুখার্জির কন্যা। সত্তরের দশকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনায় মিতালী গান গেয়েছেন পাশের বাড়ির মেয়ের মতো সাবলীলতায়। আশির দশকে বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে সাবিনা-রুনার সমান্তরালে উত্থান ঘটে মিতালীর।

কিন্তু ভারতের বরোদার মহারাজা সায়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতে শিক্ষা গ্রহণ করতে আশির দশকে মিতালী চলে যান মহারাষ্ট্রে। তার চলে যাওয়ার সঙ্গে অভিমান, বেদনা ও বিনোদন-রাজনীতির নানা ইস্যুও তখন গুঞ্জরিত হয়েছিল। সবকিছু চাপা দিয়ে ১৯৮৩ সালে ভূপিন্দর সিং-এর সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে মিতালী বোম্বেতে শুরু করেন জীবনের আরেক অধ্যায়। পাঞ্জাবি, গুজরাটি, তামিলসহ বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি একক ও ভূপিন্দরের সঙ্গে যৌথভাবে। বাংলা গানেও তিনি একাকী কিংবা স্বামীর সঙ্গে শ্রোতাদের চিত্তে জাগরূক থাকেন।

প্রদীপ গোস্বামীর কথায় ও আলাউদ্দিন আলীর সুরে নব্বুই দশকের শুরুতে ভূপিন্দর-মিতালীর গান "যেটুকু সময় তুমি থাকো পাশে/মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে/বাকিটা সময় যেন মরণ আমার/হৃদয় জুড়ে নামে অথৈ আঁধার" অদ্যাবধি স্পন্দন জাগায়। কথায় ও সুরের জাদুতে এক গভীর আবেশ সৃজন করেছিল গানটি, যাতে ব্রহ্মপুরের কন্যা মিতালীর গায়কী ও দরদের সঙ্গে মেলবন্ধন রচনা করেছিল ময়মনসিংহের জামাতা পাঞ্জাবি ভূপিন্দরের সুর-মাধুর্য্য।

জীবনের মিতালী ছিন্ন করলেও অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে এই সঙ্গীত দম্পতির গান ইথারে ভেসে ভেসে সুরে ও বাণীতে ছুঁয়ে যাবে মানুষের হৃদয়। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর