বুয়েটকাল [কিস্তি ১]

, শিল্প-সাহিত্য

শাকুর মজিদ | 2023-08-31 17:13:20

শাকুর মজিদের প্রায় সকল লেখাই আত্মজৈবনিক বলে তাঁর দাবি। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৩৬ হলেও ভ্রমণ, আত্মস্মৃতি ও স্মৃতিচারণমূলক বইয়ের সংখ্যা ২৭ টি। যা কিছুই তিনি লিখেন, সবই তাঁর নিজের জীবনের কথা—কখনো নিজের মুখে, কখনো, বিশেষ করে নাটকে তা অপর জনের মুখ দিয়ে বলান। ২০০৮ সালে বেরিয়েছিল ক্যাডেট কলেজ জীবনের প্রথম বছর নিয়ে লেখা আত্মজৈবনিক উপাখ্যান ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’। এর পর ক্যাডেট কলেজ জীবনের পরবর্তী উপাখ্যান প্রকাশ হয়েছে তাঁর ‘ক্যাডেটের ডায়েরি’তে। ক্যাডেট কলেজ থেকে বেরিয়ে ভর্তি হন বুয়েট—বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সময় ছিলেন সেখানে। এই কালটাকে ধারণ করছেন ‘বুয়েটকাল’ নামক ধারবাহিক আখ্যানে

কেমন করে বুয়েটে গেলাম

আমি কেমন করে আর কিভাবে যে বুয়েটে আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়ে গেলাম এটা আমাকে আজও ভাবায়। আমার শখ ছিল মেরিন একডেমিতে ভর্তি হয়ে যাব, বিনা খরচায় দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াব। পানির ওপর ভেসে থাকব দিনের পর দিন। লিখব বসে বসে, আর বৈচিত্রময় ভুবন দেখব। বাবার কাছ থেকে নাবিক জীবনের শোনা গল্পগুলো নিজের করে পাব।

এইচএসসির পর যথারীতি ফরমও আনালাম। নিজে ফিলআপ করে বাবার কাছে দিলাম, যেখানে অভিভাবক সই করবেন। বাবা বলেন—এটা বাদে আর যা ইচ্ছা তুমি পড়তে পারো। কিন্তু যেটা পড়বা, সেটাতেই যেন সবচে ভালো করতে পারো, এটা মনে রাখবা।

মেরিন একাডেমির ফর্ম আর পাঠানো হলো না। বাবার কাছে আম্মা গুনগুন করেন—আমার ছেলে ডাক্তার হলে ভালো।

আমি ডাক্তারি পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি। রিটেন-ভাইবা দুইটাই শেষ। রেজাল্ট হয়নি এখনো। এমন সময় আমার ক্যাডেট কলেজের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রুমমেট রায়হানের চিঠি। তার বক্তব্য—তাড়াতাড়ি ঢাকায় আয়। আমি আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি। তোর ফর্মও কিনে রেখেছি দেড়শো টাকা দিয়ে। তোর টাকা দিতে হবে না। তুই এলে একসাথে পড়ব।

বুঝে ফেলেছি। কলেজে আমি অংকে আর টেকনিক্যাল ড্রইংয়ে ভালো নম্বর পেতাম। রায়হানের দাবি, আমি ক্লাস টিচারের চেয়ে সহজে অংক বোঝাতে পারি। ইন্টারমিডিয়েটে সে আমার স্টাডিমেট ছিল। আমরা এক রুমের বাসিন্দা ছিলাম।

রায়হানের চিঠি পেয়ে মেডিকেলের রিটেন দিয়ে আমি সিলেট থেকে বিয়ানীবাজার না গিয়ে ঢাকা চলে আসি, সরাসরি রায়হানের বাসায়। রাতের বাসে করে ফুলবাড়িয়া নেমে বেবিট্যাক্সি ধরে ক্যান্টনমেন্ট, শ্যামলী হাউজিং। হাত থেকে ব্যাগ নামাতে না-নামাতেই রায়হান আমাকে ধরিয়ে দেয় এক গাইড বই। আগের দিন বুয়েটে গিয়ে সে এটা ইশতিয়াক ভাইয়ের (বর্তমানে প্রতীথযশা স্থপতি ইশতিয়াক জহির তিতাশ) কাছ থেকে নিয়ে এসেছে। আজ এগারোটার সময় মিজান ভাই ডিপার্টমেন্টে দেখা করবেন আমাদের সাথে, কোচিং নেবেন।

আমি তেমন কিছুই বুঝতে পারি না। কোচিং কেন নিতে হবে ? রায়হান বলে, আর্কিটেকচার অ্যাডমিশন টেস্টে বিশেষ রকমের ছবি আঁকতে হয়, অয়ান পয়েন্ট পার্স্পেক্টিভ, টু পয়েন্ট পার্স্পেক্টিভ, এসব আছে। ফ্রি হ্যান্ড ড্রইং আছে। তুই তো ফ্রি হ্যান্ডে পাকা, তোর লাগবে না, আমাকে শেখাবি এখন।

আমরা সকাল দশটার দিকে এসে নামি বুয়েটের আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের সামনে। দেখি, দালানটা খুব সুন্দর। নিচতলা ফাঁকা। এখানে কতগুলো খোলা পিলারের গায়ে ঠেস দিয়ে কয়েকজন বসে আছে। ছাত্র-ছাত্রীরা গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসে। অনেকটা ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতো। আমার মজা লাগে। আড়চোখে তাকাই। পড়েছি আধাসামরিক শৃঙ্খলিত আবাসিক প্রতিষ্ঠান—ক্যাডেট কলেজে। সেখানে মাসে একবার, প্যারেন্টস ডে-তে কিশোরী-তরুণী দেখা যেত। বেশিরভাগই আপা পর্যায়ের। আমরা আরেকটু বড় হয়ে গেলে যাদের দেখতাম তারা ছোট বোন। সুতরাং ইমদাদুল হক মিলন প্র্যাকটিস করার সুযোগ কই?

আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট আরো অনেক কারণে ভালো লেগে যায়। এখানে ফোর্থ ইয়ারে পড়ছেন মিজান ভাই, আমাদের কলেজের লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতায় আমরা বরাবর ফার্স্ট হতাম তাঁর ইলাস্ট্রেশনের কারণে, বোর্ডেও স্ট্যান্ড করেছিলেন। আছেন আমার নাম মিতা সোহেল, শাকুর ভাই। মেট্রিক-ইন্টার দুই জায়গায় ফার্স্ট হওয়া শাকুর ভাইকে দেখি এখানে। আরো দেখি, বোর্ডে নাইন্থ স্ট্যান্ড করা নাজমুল হাসান, আমার এক ব্যাচ সিনিয়র, সিলেটি ভাই। আছেন আমার আত্মীয় তিতাস (ইশতিয়াক জহির) ভাইও, যার বাবার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমার বাবা আমাকে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন। আমি নানা কারণে পুলক বোধ করি।

একে একে মিজান ভাই আর নাজমুল হাসান ভাইয়ের সামনে খাতা নিয়ে বসি। তাঁরা আমাদেরকে পার্স্পেক্টিভ আঁকার কৌশল শিখিয়ে দেন। নাজমুল হক ভাই আরেকটা পুরনো গাইড হাতে ধরিয়ে দেন। বলেন, নিজে নিজে প্র্যাকটিস করো। ২০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়, সাইন্স সাবজেক্টের ১৬০-এ সবাই ১৫০-১৬০ পায়। বাকি ৪০ হচ্ছে জেনারেল নলেজ আর ফ্রিহ্যান্ড ড্রইং। চান্স পেতে হলে ওই জায়গায় বেশি নম্বর পেতে হবে, মাইন্ড ইট। ৩০০০ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট পরীক্ষা দেবে, আর্কিটেকচারে সিট মাত্র ৫০ টা। চান্স পাওয়া টাফ।

আমরা দুইজন অতীব মনোযোগের সাথে তাঁদের কথাবার্তা শুনে, ব্যাগভর্তি নোট-গাইড নিয়ে রায়হানের বাসায় চলে আসি এবং পড়াশোনায় মনোযোগী হই। আমাদের হাতে এক সপ্তাহের মতো সময়। দেখি, রায়হান আমার আগমনের অপেক্ষায় তেমন আগায়নি। আমি সিলেবাস নিয়ে বসে তাকে নিয়ে পড়তে থাকি। আমার তো মেডিকেলেই পড়া হবে, আমার খুব চিন্তা নাই। পরীক্ষা দিতে হচ্ছে রায়হানের জন্য। তাকে পড়াতে গিয়ে যতটুকু পড়ছি তা দিয়েই আমার শেখা। রায়হানের ভরসা, দুজনের ভর্তি পরীক্ষার নাম্বার পাশাপাশি। সিট পাশাপাশিই পড়বে। সুতরাং তার নাকি চিন্তা নাই।

কিন্তু চিন্তায় পড়ল রায়হানই বেশি, পরীক্ষার হলে গিয়ে। বুয়েটের লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ে আমাদের সিট পড়েছে, যথারীতি রোল নাম্বার অনুসারে পর পরই, কিন্তু সেটা পাশাপাশি নয়, সামনে পিছে। একটা ডেস্কে দুইজনের জায়গা, পাশাপাশি দুই চেয়ারে। আমার সামনে রায়হান আর পাশে গোলগাল চেহারার এক শ্যামলা বর্ণের সুকেশিনী। সুকেশিনী বলছি এ কারণে যে, মেয়েটি আসন্ন পরীক্ষার টেনশনকে অতিক্রম করতে না পেরেই কি না মুখটা সারাক্ষণই প্রায় নিচু করে রেখেছিল। তার প্রোফাইলের যা কিছু আমার দেখা—তাতে নাক বরাবর মাথা থেকে ঝুলে থাকা চুলের আশের ফাঁক দিয়ে, তার দৃষ্টিকে আড়াল করে, প্রায় লুকিয়ে যতক্ষণ দেখা যায়, সে এক বা দুই সেকেন্ড কাল বা তারচেয়েও কম সময়। মেয়েটির দীর্ঘ চুল, তার বেশি অংশ পিঠের ওপর ছড়ানো, কিছু অংশ তার ঝুঁকে থাকা মাথার কারণে কানের ওপর দিয়ে লেপ্টে নাকের অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছে। পাখার কারণে খানিক বাতাস পেয়ে কিছু চুল সরে গেলে দেখা যায় তার নাকে একটা চমৎকার নাকফুলও আছে। তার চুল থেকে যে গন্ধ আসছে তা কোনো বিশেষ শ্যাম্পুর, বুঝতে পারি না। তবে আমলকি জাতীয় একটা ফলের গন্ধ সেখানে পাই। পরীক্ষায় আসার আগেই সে গোসল করেছে। পুরো চুল শুকায়নি বলেই হয়তো এভাবে মেলে ধরার চেষ্টা।

৩০ নভেম্বর, ১৯৮৪। যথা সময়ে পরীক্ষা শুরু হলে আমি বেশ দ্রুতই লিখিত অংশগুলো শেষ করে ফেলি। শেষে আঁকি ফ্রিহ্যান্ড ড্রইং। আমার ইচ্ছা হয় তাড়াতাড়ি খাতা জমা দিয়ে বলাকায় একটা সিনেমা মারি। সময় শেষ হবার আগে খাতা জমা দিয়ে দেবার পুরানো ফুটানি আমি এখানেও দেখাতে চাই, কিন্তু মন বলে, মেয়েটাকে আরো এক-দুবার দেখি। আমি বসে থাকার কাজ খুঁজি।

তাকালাম তার খাতার দিকে। সে ছবিটা আঁকছে। একজন মালি বাগানে পানি ঢালছে—এটা আমাদের সবার আঁকার বিষয়, এর জন্য নম্বর ২০। আমি যে এবার তার চুলের দিকে না তাকিয়ে আঁকা ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখছি সে টের পেয়েছে বলেই কি না জানি না, দেখি সে হাতটা যথেষ্ট সরিয়ে পেন্সিলের রিটাচিং থামিয়ে বেশ জায়গা করে আমাকে ছবিটা দেখতে দেয়।

আমি দেখি—সে চমৎকার একটা মালির ছবি এঁকেছে। রবীন্দ্রনাথের নাটকে জমিদারদের বাগানবাড়ির মালিরা যেমন থাকে, খালি গা, খালি পা, ধূতি পরা, টিনের কৌটা থেকে পানি ঢালার দৃশ্য। আমার সাথে খানিক চোখোচোখি হতেই আমি চোখের ভাষায় যেন তাকে বললাম—সুন্দর হয়েছে। জবাবে সে হাসল। আমি বুঝলাম, সে বলছে—ধন্যবাদ।

এবার মাথাটা ঘুরিয়ে চোখটা নাড়িয়ে সে আমার খাতার দিকে তাকায়। আমি বুঝলাম, সে বলছে— তোমারটা দেখি ? আমার শেষ হওয়া খাতার যে পাতাটিতে ছবি আঁকা আছে তা বাম পাশে উল্টে রেখে, যেন আমি আমারই অন্য পাতার লেখা চেক করছি এমন একটা ভাবের অভিনয় করতে থাকি, এই ভেবে যেন—সে এটা ভালো করে দেখে। মিনিট খানেক পরে যখন তার দিকে তাকাই, দেখি আমার খাতায় তার চোখ নেই, নিজের খাতায় আঁকাআঁকিতে সে ব্যস্ত।

আমার হাতে এখন কুড়ি মিনিটের মতো সময়। আমার ইচ্ছা, আরো কিছুক্ষণ বসি। আমার মনে হলো, আমার মালিটার চেয়ে ওই মেয়েটার মালি বেশি সুন্দর। আমি এঁকেছি আমাদের ক্যাডেট কলেজের হাউজ গার্ডেনের মালির ছবি। পায়ে কালো বুট, কালো মোজা, খাকির হাফ প্যান্ট, হাতে ভাঁজ করা খাকি শার্ট। আমি রাবার হাতে নেই । আমার মিলিটারি মালিকে বদলে ফেলি। রবীন্দ্রনাথের মালি বানিয়ে ফেলি, বাকি সব কিছু ঠিক থাকে।

সময় প্রায় শেষ। পাঁচ মিনিট আর আছে। দু-একজন খাতা জমা দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি কলম, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স গুটাই। আমার খাতা ভাঁজ করে হাতে নিয়ে দাঁড়াবার আগে আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকাই। সে বুঝে ফেলে, আমি তাকিয়েছি। তারও সব কাজ শেষ। পেন্সিল বক্স গোছানোর আগে তার খাতার সেই পাতাটি তার ডেস্কে এমনি মেলে রাখে যেন আমি দেখতে পাই।

আমি দেখি, সেই পাতায় বাগানে পানি দেয়া যে মালির ছবি সেটা এখন আর রবীন্দ্রনাথের নয়, খোদ কোনো ক্যান্টনমেন্টের সামরিক বড় কর্তার বাগানের মালি, পিটি সু, ফুল প্যান্ট, খাকি শার্ট, প্লাস্টিক পাইপের নল। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে উঠে পড়ি এবং খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে যাই। টের পাই, মেয়েটি আমার পিছু পিছু আসছে।

লাইব্রেরির বাইরে আমি এসে দাঁড়াই। দেখি মেয়েটি বেরিয়ে আসতেই তার বাবার (বাবাই হবে) পাঞ্জাবীর হাত ধরে ডানে বামে কোথাও না তাকিয়ে লোকটার সাথে হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

রায়হান চলে এসেছে আমার পাশে। বলে—চল। আমি আরো দাঁড়াই। রায়হান বলে—কার জন্য অপেক্ষা করিস ? আমি বলি—কিছু না। রায়হান বলে, পরীক্ষা খুব ভালো হয় নি, ম্যাথ্স্ অনেকগুলো ছেড়ে দিসি। মেজাজ ভালো না, এখন কী করবি? আমি বলি, চল—বলাকা ধরি, সিনেমা দেখব।

পনের দিন পর আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাই। এর মধ্যে মেডিকেলের রেজাল্ট হয়েছে। আমি সলিমুল্লায় চান্স পেয়েছি। কিন্তু পজিশন ৭। ঢাকা মেডিকেলে হয়ে যাবে। আমি ডাক্তার হবার প্রস্তুতি নিতে থাকি। এক বিকেলে গ্রামের বাজারে ডাকপিয়ন আমাকে একটা চিঠি দেয়। লিখেছে আমারই ক্যাডেট কলেজের আরেক বন্ধু—নাভিদ সামাদ। তিন লাইনের চিঠি—‘শাকুর, তুই আর্কিতে চান্স পেয়েছিস। কংগ্রেটস। ৮ তারিখ ভর্তির লাস্ট ডেট। তাড়াতাড়ি আয়। নাভিদ।’

সেদিন ৬ তারিখ। আমি রাতের বাসে চলে আসি ঢাকা। খবর নিয়ে জানলাম রায়হান আইএসএসবি দিতে ক্যান্টনমেন্ট গেছে (অবসরপ্রাপ্ত মেজর রায়হান খলিল এখন জাতিসংঘের লজিস্টিক ম্যানেজার হিসাবে লেবাননে চাকরিরত)। আমি আমার এক আত্মীয়ের বাসায় ভোরবেলা ব্যাগ রেখে নাভিদের বাসায় গিয়ে হাজির হই। নাভিদ তার মায়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। বলে, আমাদের ব্যাচের ৩৫ জন আর্কিটেকচারে পরীক্ষা দিয়েছিল আম্মা, মাত্র তিন জন চান্স পেল। শাকুর অনেক লাকি।

নাভিদ নিজে ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে (বর্তমানে আমেরিকার নিউইয়র্কে ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিয়ে ঔষধ বিপনন ব্যবসার সাথে যুক্ত)। তারপরও আমাকে বলে—আর্কির ব্যাপারই আলাদা, বুয়েট বলে কথা। তুই বরং আজ ভর্তি হয়ে যা।

আমি ভাবি, সেই মেয়েটাও নিশ্চয়ই চান্স পাবে, কী সুন্দর ছবি এঁকেছে!

নাভিদ আমাকে বুয়েটে নিয়ে আসে। হেডস্যারের রুমে গিয়ে একটা ক্যাশ মেমোতে ২০৬ টাকা সোনালি ব্যাংকে জমা দিয়ে এসে রিসিট জমা দিই। মেট্রিক-ইটারমিডিয়েটের সার্টিফিকেট, মার্কশিট এসবের ফটোকপি সবসময় সঙ্গে থাকত। এসব একসেট ফটোকপি করে জমা দিই অফিসে। নাভিদ বলে—তোর ভর্তি হয়ে গেল।

আমি বাইরে এসে নোটিশ বোর্ডে আমার নামও দেখি। আমি বাকি সবার নাম পড়ি। ১৪টা মেয়েও আমাদের সাথে আছে।

সে কি আছে? আমি তো তার নাম জিজ্ঞাসা করিনি। নাম জানি না। আছে তো বটেই!

আমি আমাদের সাথে ভর্তি হতে আসা কাউকেই দেখি না, কাউকে তো চিনিও না। সবাইকে কবে দেখব?
আমি জিজ্ঞেস করি অফিসের একজনকে। তিনি বলেন, আরও ১৩-১৪ মাস পর, ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ ক্লাস শুরু হবে। বাড়ি চলে যান, পেপারে নিউজ পাবেন, চিঠিও যাবে বাড়ির ঠিকানায়।

আমি আমার সতীর্থদের সাথে মিলিত হবার জন্য আরো ১৪ মাস অপেক্ষা করতে থাকি।

১৪ মাস পর ৪৯ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ১৯৮৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আমাদের ক্লাস শুরু হয় বুয়েটে। ১৪ জন মেয়ে, বাকিরা সবাই ছেলে। আমি প্রথম দিনেই সবগুলো মেয়ের দিকে তাকাই। লম্বা চুলের শ্যামলা মেয়ে আছে, কিন্তু গোলগাল চেহারার ছোটমোট কোনো মেয়ে নাই, যার নাকে একটা নাকফুলও ছিল।

কিস্তি ২. মেডিক্যাল হোস্টেলের প্যারাসাইট জীবন

এ সম্পর্কিত আরও খবর