জার্মান ভার্সনে “চিরকালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”

, শিল্প-সাহিত্য

কণা ইসলাম | 2023-08-31 07:50:42

সকাল আটটা বেজে তিরিশ মিনিট তখন। একটু ইতস্ততবোধ নিয়েই ফোনটা করলাম। কারণ অনেকেরই কাজের ব্যস্ততা না থাকলে সকাল বেলায় কিছুটা লম্বা সময় ঘুমানোর অভ্যাস থাকে। কিছুক্ষণ পরেই আমি নিজে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ব বলে বাধ্য হয়ে ফোন করলাম।

ড. অরুণ ব্যানার্জি দাদার বাড়ির ফোনে দুটো রিং বাজার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলার কণ্ঠ ভেসে এলো...হ্যালো... উত্তরে আমি নমস্তেঃ বলার সাথে সাথেই “আইন মোমেন্ট, বিটে বার্টেন জি” (অনুগ্রহ করে একটু অপেক্ষা করুন) বলেই অরুণ অরুণ বলে ডাকতে লাগলেন এবং বললেন, “আইনে ফ্রাউ সাগে-নঃমস্তে” অর্থাৎ তিনি অরুণদাকে বোঝালেন একজন ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলা তোমাকে ফোন করেছে।

যাই হোক আমিও বুঝে গেলাম অরুণদার স্ত্রী ইন্ডিয়ান নয়, জার্মান। দাদা ফোনটা নেবার আগেই তার সহধর্মিনীকে দাংকে (ধন্যবাদ) দিয়ে আমি দাদাকে হ্যালো বললাম। যে উদ্দেশ্যে তাকে আমার ফোন করা, সে বিষয়ে যাবার আগে অরুণ দা সম্পর্কে কিছুটা বলা আবশ্যক।

অরুণদার জন্ম বাংলাদেশের ঢাকা জেলায়। খুব ছোটবেলায় তিনি পরিবারের বড় সদস্যদের সঙ্গে  কলকাতায় পাড়ি জমান। তারপর ডক্টরেট করেছেন জার্মানিতে। তিনি একজন সায়েন্টিস্ট, পেশায় কেমিস্ট। বর্তমানে তিনি জার্মানির মাইন্জ ইউনিভার্সিটির লেকচারার। জার্মানিতে ৪৫ বছর ধরে বসবাস করছেন এবং ২০ বছর ধরে তিনি মাইন্জ ইউনিভার্সিটিতে বিভিন্ন ভাষাভাষী ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা শেখান।

সেদিন ১১ মে ২০১৮ ড. অরুণ ব্যানার্জির আমন্ত্রণে তার একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মান শাখার সভাপতি ইউনুস আলী খান, সিনিয়র উপদেষ্টা  মি. কারস্টেন লাঙগে (পার্লামেন্ট সদস্য সি ডি ইউ), ভাইস প্রেসিডন্ট বদরুল ইসলামসহ আমরা সংগঠনের আরো কয়েকজন সদস্য। এর আগে ড. অরুণ ব্যানার্জি, ইউনুস আলী খান ভাইয়ের আমন্ত্রণে আমাদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মান শাখা আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদযাপন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।

অরুণদার অনুষ্ঠানটি কী কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা বলছি। বাঙালির কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঘিরেই ছিল সেদিনের পুরো আয়োজন। এ বছর ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষ্য মাইন্জ রাথহাউজে (সিটি মেয়র ভবন) ড. অরুণ ব্যানার্জি তার জার্মান ভাষায় প্রকাশিত বই “চিরকালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মোড়ক উন্মোচন এবং জার্মানদের মাঝে প্রদর্শন করেছেন। বইটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী নিয়ে লেখা বিভিন্ন গল্পের ১৪ জন লেখকদের মধ্যে অনেকেই সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট জার্মান, ইরানী এবং কিছু সংখ্যক টার্কিস, যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে জানেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি নিয়ে রিসার্চ করেন। বিশিষ্ট সকল লেখক এবং ব্যক্তিগণের প্রত্যেকেই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি, বিভিন্ন লেখা, জীবনী এবং তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে আলোকপাত করেন। প্রজেক্টরের মাধ্যমে নৃত্যনাট্যসহ রবীন্দ্রনাথের কিছু দুর্মূল্য ছবি এবং তাঁর বিভিন্ন সময়ে আঁকা কিছু চিত্রকর্ম তুলে ধরেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বিদেশীদের মাঝে অরুণদার এই কাজটি অনন্য। বই বিক্রির সমস্ত অর্থ আসামের একটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “ফাতিমা বালিকা দয়াধাম”—যেখানে পথশিশুদের ট্রেনিং এবং শিক্ষা প্রদান করা হয়, সেখানে দান করা হবে।

জার্মানিতে বিশ্বকবিকে নিয়ে উৎসাহের শেষ নেই । এখনো তাঁদের অনেকেই কবিগুরুকে নিয়ে, রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে তাঁদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জার্মান ভার্সনে প্রকাশিত “চিরকালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর” বইটিতে লেখা বিভিন্ন গল্পের রাইটারদের সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানতে পারলাম এবং অরুণদার নিজের কিছু কথাও জানলাম। বললেন বইটি প্রকাশ করতে আট বছর সময় লেগেছে তার এবং যাবতীয় খরচের প্রায় সবটাই তিনি নিজে বহন করেছেন। খুব সামান্য সাহায্য করেছেন প্রকাশক পোয়েট্রি এ্যাসোসিয়েশন। বইটির শুরুতেই প্রতিভা প্রকার (Consul General of India in Frankfurt) তার একটি বাণী দিয়েছেন।  অরুণদা বললেন, তিনি জার্মান ভালো বোঝেন না, সেকারণে তার বোঝার সুবিধার্থে বইটিতে গৃহীত সকল লেখকের গল্পগুলো প্রথমে তিনি নিজে ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করেছেন প্রতিভা প্রকারের বোঝার সুবিধার্থে। এটাও অনেক সময় সাপেক্ষ কাজ।

বইটির প্রথম গল্পের লেখক সম্পর্কে সামান্য কিছু কথাঃ Martin Kämpchen তিনি শান্তিনিকেতন সংলগ্ন একটি গ্রামে বসবাস করেন এবং রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সকল সৃষ্টি নিয়ে এখনো গবেষণা করে যাচ্ছেন। জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এ যাবত যা কিছু লেখালেখি হয়েছে তার সবই এই লেখকের মাধ্যমে। Christine Kupfer দ্বিতীয় গল্পের লেখক, তিনি একজন স্কটিশ। স্কটিশ টেগর রিসার্স সেন্টারে তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। Lars-Christian Koch বিশিষ্ট লেখক, জার্মানির বার্লিনে বসবাস করেন। তিনি রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে গবেষণা করেন এবং রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে তিনি “My Heart Sing” বইটি লিখেছেন। লেখিকা Sonja Wengoborski  একজন শ্রীলঙ্কান। কবিগুরুর জীবদ্দশায় শ্রীলংকায় অনেক যাতায়াত ছিল। সেই সকল জীবন এবং কর্ম নিয়ে লেখিকা তাঁর গল্পে আলোকপাত করেছেন।  লেখিকা-Nina-Mareike Obstoi  অরুণদার ছাত্রী। বুদ্ধিষ্টদের ওপর রিসার্চ করেন। Rita Panesar, Michael Gerhard,  Almuth Degener Merlin Kräker-ও চমৎকার লিখেছে।

চিরকালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইটির সবচেয়ে বড় দুটি গল্পের লেখক অরুণদা নিজে। বইটির চার নম্বর গল্প তার “Baul songs of Tagore গল্পে কবিগুরুর বাউল জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোকপাতের পাশাপাশি কবির বিভিন্ন গান যেমন, ১. এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী, ২. আমার মন যখন জাগলি নারে, ও তোর মনের মানুষ এলো দ্বারে, ৩. যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু ইত্যাদির বাংলাসহ জার্মানে ট্রান্সলেট করেছেন।

অরুণদার মুখে একটি কথা শুনে আমার অত্যন্ত ভালো লাগল। তিনি জানালেন, জার্মান ভাষায় তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে আরো একটি বই লিখছেন যেটা এখনো শেষ হয়নি এবং বললেন এই বিষয়ে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইমতিয়াজ আহমেদের সাথেও কথা বলেছেন তিনি। আমাদের সকল বাঙালিদের জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর