বুয়েটকাল [কিস্তি ২]

, শিল্প-সাহিত্য

শাকুর মজিদ | 2023-08-29 19:08:28

 কিস্তি ১. কেমন করে বুয়েটে গেলাম

মেডিক্যাল হোস্টেলের প্যারাসাইট জীবন 

১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ঢাকা চলে আসি। বিদেশ থেকে বাবার আনা একটা স্পঞ্জের তোশক  আর একটা বিদেশি লাল রঙের কম্বল ছিল আমার খুব প্রিয়। ১৯৭৮ সালে কালো রঙের যে টিনের বাক্স নিয়ে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে গিয়েছিলাম সেই ট্রাঙ্কটি প্রায় অক্ষতই ছিল। শুধু তাই নয়, এই ট্রাঙ্কে সাদা রঙ (এনামেল পেইন্ট) দিয়ে নিজের হাতে নিজের যে নাম লিখেছিলাম, সেই নামটিও প্রায় অক্ষত অবস্থায় আছে। সেই ট্রাঙ্কের ভেতর আমার সমূহ সম্পত্তি, মানে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার কাটিং স্ক্রেপ বুক, নানা রকমের লিটিল ম্যাগাজিন, কিছু ফটোগ্রাফ, দুই জোড়া জুতা, স্যান্ডেল, কাপড়-চোপড় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য চলে আসি। এসে উঠি মহাখালীতে আমার বাবার এক চাচার বাসায়। এসে বলি, কাল পরশুর মধ্যে আমার হলের সিট হয়ে যাবে, চলে যাব। কিন্তু আমি তো জানি কাল-পরশুর মধ্যে আমার সিট কী করে হয়! অফিসিয়ালি ক্লাস শুরু হতে আরো দুইমাস বাকি। আমি শুনেছি টিউশনি করে অনেক টাকা কামানো যায়। আমি সেই উদ্দেশ্যে আগাম চলে আসি ঢাকায়।

বাবা মারা গেছেন কয়েক মাস আগে। বাড়িতে মা আছেন, আর আছে ছোট ছোট ৪ ভাই বোন। আমি সবার বড়। বাবা মারা যাবার পর বাবার প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল সে টাকার একটা বড় অংশ নিয়েছেন আমাদের এক আত্মীয়। তিনি এই টাকায় ব্যবসা করছেন। মাকে মাসে মাসে টাকা দেন, তার খরচ চলে যায়। বাকি সামান্য যে কিছু টাকা আছে তা থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে চলে এসেছি ঢাকায়। ঢাকার জীবন শুরু হবে এখান থেকে।

মহাখালী থেকে ৬ নং বাসে হাইকোর্ট, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বকশী বাজারে ডাঃ ফজলে রাব্বী হল।

সেখানে আলাউদ্দিন আছে। ক্যাডেট কলেজে একসাথে ছিলাম ৬ বছর। বেশ কয়েকবার একই রুমেও। শুনেছি এসব হলে ছাত্রদের সাথে থাকা যায়। আমাকে দেখে আলাউদ্দিনের খুব উচ্ছ্বাস । এটা কোনো ব্যাপার হলো! আমাদের থ্রি সিটেট রুম। একটা বিছানা খালিই থাকে। যার জন্য এলোটেড ঢাকায় তার বাসা ঢাকায়, সে মাঝে মাঝে আসে, সমস্যা নাই, তখন আমরা ডাবলিং করব। তুই চলে আয়।

পরদিনই লেপ-তোশক নিয়ে ঢাকা এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. ফজলে রাব্বাী হলের ২১ নম্বর রুমে উঠে পড়ি। তাদের ক্লাস শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগেই। এই রুমে আলাউদ্দিনের আরেক রুমমেট আছে, হুমায়ূন। আমি তাকেও খাতির করে চলি। মাঝে মাঝে সিঙারা এনে খাওয়াই। তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, যত তাড়াতাড়ি আমি বিদায় হই, ততই তাদের মঙ্গল। হুমায়ূন আমাকে প্রায়ই জিগ্যেস করে, তোমার সিট হয় নাই ?

আমি মুখে কিছু না বলে, মাথা নাড়াই।

মেডিকেলের হোস্টেলে এ রকম বেশ কিছু বহিরাগত থাকে। ছাত্রদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন। এদেরকে বলা হয় প্যারাসাইট। এ রকম আরো প্যারাসাইটের খোঁজ পেলাম ৮ নং রুমে।

ডা. ফজলে রাব্বী ছাত্রাবাসের ৮ নম্বর রুমটা বেশ জটিল। সেখানে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের আমাদের ব্যাচের তিনজন থাকে। তারা জেনুইন মেডিকেল স্টুডেন্ট। আর দুইজন থাকে প্যারাসাইট। একজন ঝিনাইদহ, আরেকজন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের। প্যারাসাইট-প্যারাসাইট ভাই ভাই, তাদের মধ্যে খুব দ্রুত খাতির হয়ে যায়। এদের দুইজনের সাথেই আমার খাতির হয়ে গেল। একজনের নাম নাদীম। তার সঙ্গে আমার পত্রমিতালী ছিল। ইয়াং অবজারভারের পেন-প্যাল বিভাগে একবার আমার নাম ঠিকানা ছাপিয়েছিলাম। কয়েকটা মেয়ে আর কয়েকটা ছেলে আমাকে চিঠি লিখেছিল। একটা ছেলে লিখেছিল ইংরেজিতে। তার নাম ছিল নাদীম।  সে ইংরেজিতে খুব ভালো। ইংরেজি পত্রিকা পড়ে। তার বিছানায় টাইমস-নিউজ উইক, স্টার ডাস্ট থাকে। আমি মাঝে মাঝে নিয়ে উল্টাই। আর ভাবি, এখানে কী কী আছে যা অনুবাদ করা যায়। কারণ এর মধ্যেই আমি অনুবাদের কিছু কাজ করে কয়েকশো টাকা আয় করে ফেলেছি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ৮ নম্বর কামরার অরিজিনাল বাসিন্দা বাবু। সে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের। বাবুর একটা অটোফোকাস ক্যামেরাও আছে, ইয়াসিকা এমএফটু। চা-সিঙারা খাইয়ে বাবুর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করি। বাবুর ক্যামেরায় টিপ দিলেই ছবি ওঠে। ছবি তুলতে খুবই আনন্দ আমার। হোস্টেলের সামনে আলিয়া মাদ্রাসার গেটের কাছে ভিখিরিদের ছবি তুলি, নিউ মার্কেটে নিয়ে ফিল্ম প্রসেস করি। বি-টু সাইজের ছবি প্রিন্ট করে নিয়ে আসি। ১০ টাকায় পাঁচ কপি প্রিন্ট করা যায়।

একজন একটি টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছে। মন্ত্রী মাইদুল ইসলামের বোনকে (নাম সম্ভবত পলি) পড়াই। সপ্তাহে তিন দিন। মাসে ৬০০ টাকা বেতন। টিউশনি শেষে আমার হাতে অনেক সময়, আমি আরো কিছু কাজ চাই।

একসময় বাবু বলে, ‘তুই তো লিখতে পারিস, পত্রিকায় লেখ না, অনেক টাকা পাওয়া যায়।’

পত্রিকায় ছাপার হরফে কেবল লেখা দেখেই তুষ্ট ছিলাম এত দিন। এখন শুনলাম, এখান থেকে টাকাও আসে। বিষয়টি মাথায় চক্কর দিতে থাকে। সিলেটের গ্রাম থেকে ডাকযোগে কয়েকটি লেখা পাঠিয়েছিলাম এক পত্রিকায়, কিছু কবিতা, কিছু গল্প। একটি কবিতা এবং একটি গল্প ছাপা হয়েছে অনেক আগে। তাহলে কি এগুলোর জন্য টাকা পাওয়া যাবে?

অনেক কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করে হাজির হই টিকাটুলির অভয় দাস লেনের ১৩/বি বাড়িতে। এই বাড়ি থেকে বেরোয় মাসিক রোকসানা। সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হয় সৈয়দা আফসানার, কিন্তু পত্রিকা দেখেন প্রায়বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক। তিনিই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত পাইলট রোকসানার বাবা। মেয়ের নামে পত্রিকা বের করছেন। তাঁর বাসার ড্রয়িংরুমই পত্রিকার অফিস।

পত্রিকার একজন লেখক দেখা করতে এসেছেন শুনে তিনি খুবই খুশি। তিনি কোন্ আইসক্রিম আনিয়ে খাওয়ান আমাকে। আইসক্রিম খাওয়ার ফাঁকে তাঁর কাছে আমার মনোবাসনা উত্থাপন করি। লেখার জন্য সম্মানী পাওয়া যায় কি না, জানতে চাই।

চশমার ফাঁক দিয়ে তিনি তাকান আমার দিকে। বলেন, কিছু ফিচার, অনুবাদ, এসবের কাজেই তিনি লেখকসম্মানী দেন, যত পৃষ্ঠা ছাপা হবে ততশো টাকা, এটা তাঁর পত্রিকার নিয়ম। জানতে চান, আমি কোন বিষয়ে লিখতে আগ্রহী। বলি, অনুবাদ করতে পারব। দেন।

তিনি প্রথমে একটা রিডার্স ডাইজেস্ট দিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ওপর একটা লেখার অনুবাদ করতে বলেন। আমি এই টেক্সটের সাথে ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে আরো কিছু জোগাড় করে লিখে দিলাম। তিনি পড়লেন এবং ড্রয়ার থেকে দু’শো টাকা বের করে দিয়ে দিলেন। বললেন, এরকম ইন্টারেস্টিং কিছু পেলে নিয়ে আসবেন।

আমি নাদীমের সাথে খাতির লাগাই। তার কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্য ইংরেজি পত্রিকা নিয়ে আলিয়া মাদ্রাসার গেটের কাছে ফটোকপি করিয়ে ফেরত দিয়ে দিই। রাত জেগে লেখা অনুবাদ করে  মাসিক রোকসানা পত্রিকার অফিসে চলে যাই।

একদিন সম্পাদক পিতাকে (যিনি সম্পাদিকা তাঁর সাথে দেখা হয়নি। পিতার সাথেই দেখা হতো) বলি, আমি হুমায়ূন আহমেদের একটা ইন্টারভিউ করতে চাই। করব?

তিনি রাজি হয়ে গেলেন।

আমি মেডিকেল হোস্টেলে এসে হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই। ফোন করার জন্য বারান্দায় কয়েন বক্সের সামনে লাইনে দাঁড়াতে হয়। আমাদের মতো প্যারাসাইটদের লাইনে দেখলে হোস্টেলের অরিজিনাল ছাত্ররা বিরক্ত হয়। কিন্তু উপায় নেই। আমাকে ফোন করতে হবে। আমি কয়েকটা সিকি হাতে নিয়ে দাঁড়াই এবং একসময় লাইনের সামনে এসে ফোন ধরার সুযোগ পাই। ফোন করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্সচেঞ্জে। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ড. হুমায়ূন আহমেদকে চাই। ওপাশ থেকে অপারেটর সংযোগ ঘটিয়ে দেন সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে কার্জন হলে। সেখানে যিনি ফোন ধরলেন, তিনি খুবই দয়াবান এক ভদ্রলোক। সাংবাদিক পরিচয় জানার পর তিনি আমাকে জানালেন, ড. হুমায়ূন আহমেদ এখন তাঁর রুমে নেই, তিনি বাসায় চলে গেছেন। তিনি তাঁর বাসার ফোন নম্বরটি দিয়ে দেন।

সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে আরো দুটি সিকি ঢুকে যায় কয়েন বাক্সের ছিদ্র দিয়ে। ওপাশে ফোন ধরেন স্বয়ং ড. হুমায়ূন আহমেদ। ঠিক হয় কাল বিকাল তিনটায় আমি তাঁর বাসায় যাব। আমার সঙ্গে একজন ফটোগ্রাফারও থাকবে।

কাল বিকেল তিনটা, এখন থেকে প্রায় ২২ ঘণ্টা বাকি। আমার চোখে মুগ্ধ হওয়ার স্বপ্ন। বাবুকে সব ঘটনা খুলে বলি। বাবু উৎসাহী হয়ে পড়ে। সে প্ল্যান করেছে, তার ক্যামেরার সাথে রুমের বড় টেপ-রেকর্ডারটাও নিয়ে যাবে। সারা রাত জেগে নোটবুকে কতগুলো প্রশ্ন লিখে রাখি। হাতের কাছে ছিল একটা উপন্যাস, ‘তোমাকে’, সেটাও পড়ে ফেলি। আমি এই প্রথম পর পর দুইদিন সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করে করে হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। তারিখটা ছিল ২১ ও ২২ জানুয়ারি ১৯৮৬।

ডাঃ ফজলে রাব্বি হলের ৮ নং রুমে আরেকজনের সাথে পরিচয় হয়। নাম তৌকীর। সেও নাকি বুয়েটে চান্স পেয়েছে। আর্কিটেকচারে। তবে তাকে গভীর রাত না হলে রুমে পাওয়া যায় না। বিকেলে টিউশনি করে। এক ছাত্রীকে বাড়ি গিয়ে ড্রয়িং শেখায়, আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দেবে মেয়েটি। আবার এক কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেয়। প্রতি ক্লাসে ১০০ টাকা পায়। তার ভালো ইনকাম। সে আবার ‘থিয়েটার’ দলেও নাকি চান্স পেয়েছে। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা যায়।

এরমধ্যে একদিন এই হোস্টেলের ঠিকানায় রি-ডাইরেক্ট করা রেজিস্টার্ড উইথ এডি একটা খাম আসে আমার কাছে। খামের ওপরে লেখা—রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহৃত। খুলে দেখি সিলেট বেতারের একটা চুক্তিপত্র আর ৪৮০ টাকার মানি রিসিট। সেখানে লেখা—‘যে যাহা করো রে বান্দা আপনার লাগিয়া  নামক সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার নাটকটি আগামী ১৭ জানুয়ারি সিলেট বেতার থেকে প্রচার হবে।’

আমি মহা উত্তেজিত হয়ে খবরটি তৌকীরকে জানাই। সে তখন থিয়েটারে নতুন ডাক পেয়েছে। প্রতিদিন ওয়ার্কশপে যায়, ফেরে গভীর রাতে। আমার ইচ্ছা করে তার সাথে নাটকের রিহার্সালের গল্প শুনতে। কিন্তু তাকে ফ্রি পাওয়া যায় না।

আর আমি ছোট্ট একটা অটোফোকাস ইয়াশিকা এমএফটু ক্যামেরা নিয়ে ঘুরি। ছবি তুলি। দুয়েকটা পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপিয়ে পরের সপ্তাহ থেকে সেই পত্রিকা অফিসে বিল সংগ্রহের জন্য ঘুরে ঘুরে সময় কাটাই আর নতুন টিউশনি খুঁজি। এই নিয়ে সময় কাটাতে কাটাতে সপ্তাহ দুই পরে তিতুমীর হলের সিটে আমার জায়গা হয়। আমি বুয়েট জীবন শুরু করি। ১৯৮৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় আমাদের ক্লাস। তার কিছুদিন পর বুয়েটের তিতুমীর হলের ১০৬ নং রুমে আমার ঠাঁই হয়। শুরু হয় আসল বুয়েটকাল।

কিস্তি ৩. বুয়েটপরশ

এ সম্পর্কিত আরও খবর