হেলেন সাবিত্রী শ্যামলী

, শিল্প-সাহিত্য

ওমর শামস | 2023-08-31 12:29:24

উপস্থাপনা
এড্গার অ্যালান পো’র কবিতা এবং কবিতা সম্পর্কে তার বিখ্যাত সন্দর্ভ, ‘The Poetic Principle’, সম্ভবত তিরিশের কবি জীবনানন্দ দাশ এবং বিষ্ণু দে উভয়েই পড়েছিলেন। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেওয়া মুশকিল। তবে অ্যালান পো’র ‘To Helen’ কবিতাটির অনুবাদ বিষ্ণু দে করেছিলেন—অ্যালান পো’র সম্মানে—এই শিরোনামে। কবিতাটি ‘আলেখ্য’ কবিতাগ্রন্থ, ১৯৫৮-তে অন্তর্ভুক্ত। আর জীবনানন্দর ‘বনলতা সেন’ কবিতায় যে অ্যালান পো’র ঐ কবিতার তীর্যক ছায়া আছে তা আমরা বুদ্ধদেব বসুর ‘বোদলেয়ার, তাঁর কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকার পাদটীকায় জেনে গেছি। আমার উদ্দেশ্য মূল কবিতাটি প্রচ্ছন্ন রেখে বিষ্ণু দে’র ‘এড্গার অ্যালান পো’র সম্মানে’ এবং জীবনানন্দ দাশের ‘শ্যামলী’ কবিতা দুটির আলোচনা করা, যার মাধ্যমে এই দুটি সমসাময়িক কবির কবিতা-চিন্তা সম্পর্কে কিছুটা অন্তর্দৃষ্টি পেতে পারি। কবিতা দুটো উদ্ধৃত করি, মূল ইংরেজি কবিতাটি পাদটিকা পুনর্মুদ্রিত।

এড্গার এলান্ পো-র সম্মানে
সাবিত্রী। তোমার রূপ আমার নয়নে
প্রাচীন ময়ুরপঙ্খীসম, মনে হয়,
সুগন্ধ সমুদ্রে চলে মন্তর গমনে,
শ্রান্ত দীর্ঘ পথক্লান্ত প্রবাসীকে বয়
আপন স্বদেশে তার একাগ্র তন্ময়।
কত না দুরন্ত সিন্ধুবিহারের পরে
তোমার অতশী কেশ, সারস্বত মুখ,
নির্ঝর তোমার লাস্য ফিরায়েছে ঘরে
মথুরার অলৌকিক গৌরবে উন্মুখ,
বৈভবের ইন্দ্রপথে অমর আখরে।

ঐ! দেখি সমুজ্জ্বল গবাক্ষবেদীতে
তোমাকে প্রতিমাসম আভঙ্গে নিশ্চল,
মর্মরপ্রদীপ হাতে নিথর অঞ্চল!
আহা! মনসিজে! জ্বেলে দিলে ধরাতল
স্বর্লোকের পুণ্যময় জ্যোতিষ্কসংগীতে।

শ্যামলী
শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন;
যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল
সুদূর নতুন দেশে সোনা আছে বলে,
মহিলারি প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল
টের পেয়ে, দ্রাক্ষা দুধ ময়ূরশয্যার কথা ভুলে
সকালে রূঢ় রৌদ্রে ডুবে যেত কোথায় অকূলে।

তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনো
আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রের নীল,
দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা,
বিকেলের উপকণ্ঠে সাগরের চিল,
নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব—
শ্যামলী, করেছি অনুভব।

অনেক অপরিমেয় যুগ কেটে গেল;
মানুষকে স্থির—স্থিরতর হতে দেবে না সময়;
সে কিছু চেয়েছে বলে এত রক্তনদী।
অন্ধকার প্রেরণার মতো মনে হয়
দূর সাগরের শব্দ—শতাব্দীর তীরে এসে ঝরে :
কাল কিছু হয়েছিল;—হবে কি শাশ্বতকাল পরে।

বিষ্ণু দে

বিষ্ণু দে তাঁর কবিতার শিরোনামে অ্যালান পো’কে স্মরণ করেছেন। কবিতাটি ‘হেলেনের প্রতি’ মূল কবিতার আক্ষরিক অনুবাদ না হলেও অন্তর্দীপ্ত অনুবাদ। হেলেনের পরিবর্তে সনাতন সংস্কৃতির সাবিত্রীকে সম্বোধন করেছেন, যাঁর রূপ প্রাচীন ময়ূরতরীর মতো শ্রান্ত দীর্ঘ পথক্লান্ত পরিব্রাজককে সুগন্ধ সমুদ্র বেয়ে আপন স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়। ‘তোমার অতশী কেশ’, ‘স্বারস্বত মুখশ্রী’, (হাওয়ার) নির্ঝরের আহ্বান, দুরন্ত সমুদ্রযাত্রায় টেনে ‘বৈভবের ইন্দ্রপ্রস্থে’, ‘গৌরবে’-র ‘মথুরায়’ ফিরিয়ে এনেছে। গবাক্ষপটে তোমাকে ‘আতঙ্কে নিশ্চল’, ‘মর্মর প্রদীপ হাতে’, ‘প্রতিমা’র মতো দেখাচ্ছে। আহা! মন, ধরাতলে জ্বালিয়ে দিলে ‘স্বর্গলোকের পুণ্য’ ‘জ্যোতিষ্ক সংগীতে’। এই তো কবিতা। Necean barks of yore that gently, o’er a performed—এই বাক্য ও তার ব্যঞ্জনা বাংলা তর্জমায় অনেকখানি এসেছে, তবে ‘that’-এর অভাব বাংলায় এই প্রত্যক্ষ-নিষ্ঠাকে কিছুটা তরল করেছে। কিন্তু উপায় নেই, বিষ্ণু দে অক্ষরবৃত্তে অনুবাদ করেছেন এবং মূল কবিতার ধ্বনি-লয়-সূক্ষ্মতা যতটা সম্ভব বজায় রেখেছেন। প্রথম ৪ লাইনে ‘নয়নে’, ‘হয়’, ‘গমনে’, ‘বয়’—কখকখ-এর পরে ঠিক অ্যালান্ পো’র ‘to his own native shore’-এর মতো আপন স্বদেশে তার একান্ত তন্ময় ঠিক সারেঙ্গীর মতো সুরের পিছু নিয়েছে। বিষ্ণু দে’র মতো ছন্দকুশলী ব্যতিরেকে এই মিল সমন্বয় মুশকিল ব্যাপার। দ্বিতীয় স্তবকেও ধ্বনির এই একই সামঞ্জস্য মূল কবিতার সঙ্গে বজায় রেখেছেন। শুধু শেষ স্তবকে সামান্য স্বাধীনতা নিয়েছেন ক খ খ খ ক ব্যবহার করে। এবং ‘আহ্’ হৃদয় সেই সব প্রদেশ থেকে যেগুলো পুণ্যভূমি এই বার্চ্যাথরে বদলে—‘আহা! মনসিজে! জ্বেলে দিলে ধরাতল স্বলোকের পুণ্যময় জ্যোতিষ্ক সংগীতে’—এই তর্জমায় সামান্য স্বাধীনতা নিয়েছেন। সেও ছন্দোরক্ষার দাবিতে।

মূল এবং ভাবানুবাদ, উভয়েই হোমরের অডিসিকে স্মরণ করায়। হেলেন বা সাবিত্রী এখানে সন-তারিখে সীমাবদ্ধ ঐতিহাসিক চরিত্রই থাকে না, এখানে সর্বকালীন নারীর রূপ-সৌন্দর্য-সখ্য-সান্নিধ্য-শান্তি-সুূখ-পুণ্য প্রেমদায়ী সত্তা—অ্যালান পো’র জন্য পবিত্র, স্বর্গীয়, ধর্মীয়; বিষ্ণু দে’র জন্য ‘স্বলোকের পুণ্যময় জ্যোতিষ্কসংগীতে’।

একটু ধ্বনি-বিচার দরকার, কেননা বোধ কবিতার আত্মা হলেও ধ্বনির মধ্যে দিয়েই তো অবশেষে তাকে প্রকাশিত হতে হয়। বিষ্ণু দে’র অনুবাদ আগাগোড়া ৮ + ৬ = ১৪ এই মাইকেলী অক্ষরবৃত্তের চলনে এবং যুগ্ম ভারী শব্দের ব্যবহার প্রত্যেক পঙ্‌ক্তিতে অতএব ‘সাবিত্রী! তোমার রূপ!! নয়নে!! প্রাচীন ময়ূরপঙ্খী!! সম মনে হয়!!—এভাবে সহজেই পাঠ করা যায় যাতে একই পর্ব-পর্বাঙ্গের পুনরাবৃত্তি “হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব!! বিবিধ রতন!!’—এর চালে বাজতে থাকে। কিন্তু এই সনাতন চলন এড়িয়ে কবিতাটিতে এতটা বিলম্বিত চালেও—

সাবিত্রী! তোমার রূপ আমার নয়নে প্রাচীন ময়ুরপঙ্খীসম,
মনে হয়
সুগন্ধ সমুদ্রে চলে মন্থর গমনে
পাঠ করা চলে। এবং এতেই বোধ হয় কবিতার স্বরূপ বেশি স্ফুট হয়।

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দর কবিতার নাম শ্যামলী—সাবিত্রী বা হেলেন-এর মতোই একটি নাম যা সমগ্র নারীসত্তাকে পুরুষের অভিলাষাতুর, নারী-প্রতিমাকে ধারণ করে থাকে। এ কবিতা ‘হেলেন-এর প্রতি’র অনুবাদ মোটেই নয়। তবুও এই ১৮ লাইনের, ৩ স্তবকের পিছনে অ্যালান পো’র ১৫ লাইনের ৩ স্তবকের অশরীরী ছায়ার মতো অস্তিত্বমান অ্যালান পো’র মূল দ্যোতনাসূত্র : কোনো ক্লান্ত তাড়িত-অবসিত পরিব্রাজককে হেলেনের রূপ যেন পুরাণের বজরার মতো দূর সমুদ্রের ওপর দিয়ে ঘরে ফিরিয়ে আনে—Helen, thy beauty, এই সম্বোধন চিত্রকল্পকে আরো বিমূর্ত-ব্যঞ্জনাবহ করে জীবনানন্দ আরো প্রত্যক্ষ : ‘শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন...’।

অ্যালান পো (এবং বিষ্ণু দে’র প্রথম স্তবকের বিস্তৃত উপমানকে কেন্দ্রে সংকুচিত করে তাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করেন এবং এই শক্তিকেই তুলনা করেন শ্যামলীর আহ্বানকুশলী মুখের সঙ্গে। তারপর মেলে ধরেন য়ূরোপীয় মূল চিত্রকল্পটি যে ঐ শক্তির আকর্ষণেই সনাতন যুবকেরা সম্পদ সম্ভোগের ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে, সাহসে-অভীপ্সায় দূর-সমুদ্র পাড়ি দিত। যেখানে সাবিত্রী (Helen)-এর মুখের মূল উপমান সনাতন ময়ূরপঙ্খী (Necean Barks), জীবনানন্দর শ্যামলীর উপমান ‘সেকালের শক্তি’, যা.......। ‘সেকালের শক্তির মতন’ মুখ, ‘মহিলারী প্রতিভায়...উজ্জ্বল’ ‘সুদূর দেশে.... সোনা’, ‘দ্রাক্ষা, দুধ, ময়ূরশয্যার কথা তুলে’ যুবাদের সমুদ্রযাত্রা—এইসব অনুষঙ্গ জ্বলে উঠতেই, জীবনানন্দ দ্বিতীয় স্তবকে নারীজয়ের বিফলতার বেদনাকে জাগিয়ে তোলেন : শ্যামলীর মুখের দিকে তাকালে এখনো.... সেই পৃথিবীর সমুদ্রের নীল, দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা, বিকেলের উপকণ্ঠে সাগরের চিল, নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন’—সব মৃদু রবে-নীরবে উত্থিত হয়ে ওঠে। জীবন্ত বর্তমান থেকে হোমরীয় যবনকাল পর্যন্ত আনন্দ-অভিলাষ-বেদনার সেতু রচনা করতে করতেই শেষ স্তবকে জীবনানন্দ ইতিহাস খুঁড়ে তোলে তার বিস্ময় ও বিপন্নতা। মানুষ ‘কিছু চেয়েছে বরে এত রক্তনদী—এই বিষণ্ণতা কি সৃষ্টির অন্তর্গত আরোপিত গ্রন্থনা, না এর ইতিহাসের দাবার চালের ঘটনা পরম্পরা?’ অনুচ্চারিত প্রশ্ন পৌণপুণিকভাবে দুলতে থাকে। ‘দূর সাগরের শব্দ’ সনাতন যুগ থেকে আজও এই শতাব্দীর তীরে এসে ঝরে পড়ে। কাল কি কিছু হয়েছিল—নেতি বা ইতিমূলক? শাশ্বতকাল পরেও কি হবে? এই প্রশ্ন দিয়েই কবিতা শেষ হয়ে যায়।
এই কবিতার শেষ দু’লাইনে কিছুটা নেতির সুর থাকলেও জীবনানন্দ কখনোই আত্মঘাতী ক্লান্তিতে পর্য্যুদস্ত নন। বিশেষ করে তাঁর শেষ পর্বের অনেক ইতিহাস ও সমাজ বিবর্তন—সাংঘর্ষের কবিতায় তিনি বরং স্বীকার করে গেছেন যে হয়তো প্রকৃতির নিয়মের ভিতরেই নিরংকুশভাবে মানুষের জন্য শুভ-অন্তিম প্রত্যয়িত হয়ে আছে।

ধ্বনি বিচারে জীবনানন্দ অবশ্যই বিলম্বিত মেজাজের কবি। এবং এই কবিতাটিতেও তাঁর এলানো মুক্তক; অক্ষরবৃন্ত এবং সঙ্গে সঙ্গে যুক্তাক্ষর বিরল (যে কটিও আছে তারাও লয়ের ঢিমেচালে ঢুলে-ঢুলে পড়ে। এবং মিলও সহজ ‘বলে’, ‘ভুলে’, ‘অকূলে’, ‘নীল’, ‘ঢিল’—সবই স্বরাঘাতবিহীন। এই দীর্ঘ লয়ের সুরে অবশ্যই—এবং তার অন্যান্য কবিতার মতো—ইতিহাসের দূরত্ব, ভূগোলের দূরত্ব এবং বিস্তৃতি, সময়তটে নারীর বিস্তৃতি, মানুষী জীবনের বোধ; আকাঙ্ক্ষা, বেদনা, শূন্যতা, অস্থিরতা, প্রেম, প্রেমহীনতা—সব দূর সাগরের শব্দের মতন শতাব্দীর তীরে এসে ঝরে। এই ম্যাজিক জীবনানন্দীয়। এবং সেইজন্যই তিনি অনুবাদ না করে স্বাধীনতা নেন যেমন নেন ‘হায় চিল’ কবিতা রচনায়।

উত্তরণ

বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ উভয়েরই বিষয় প্রেম—উত্তীর্ণ অ্যালান পো’কে অনুসরণ করে, যিনি তাঁর পূর্বসূরী হোমরের হেলেনকে স্মরণে নিয়ে এসেছেন। উভয় কবিতাই বর্তমান কালবিন্দুর প্রেয়সী ও প্রেম নয়। রোমান্টিকস্‌রাই—ইংরেজ বা জর্মন যাই হোক—এই কালক্রমণের অগ্রজ। এই অনুষঙ্গ ও তার ব্যঞ্জনা জীবনানন্দ’র (বিষ্ণু অবশ্যই অনুবাদে সীমাবদ্ধ) মতো কবির হাতে পৌনপুণিকভাবে পরিবর্ধিত হয়ে যায় কেননা তিনি আকাঙ্ক্ষা-প্রেম-দুঃসাহস-পরিব্রজ এগুলোগে যুগের পর যুগের মানুষের প্রগতিযাত্রার সঙ্গে গেঁথে তুলতে পারেন—প্রেমকে আরো সংহতি এবং গভীরতা দিতে পারেন। পরবর্তী কালের বেদনা—বিষণ্ণতা—‘বন্দরের ব্যথা’—যুগের অস্থিরতা—এগুলোকে প্রেম ও আকাঙ্ক্ষা সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারেন। এই ক্রমআনুষাঙ্গিক প্রকাশেই কবিতার সারপদার্থ বাড়ে, প্রেমকে আমরা আরেকটু বেশি করে আবিষ্কার করি। শুধু হোমর-কালিদাসের কালই নয় বা একান্ত বর্তমান নয় বরং এই দুই কালের মধ্যে পট ও প্রবাহের অন্তঃসলিল এমনকি ভবিষ্যতের আশঙ্কা ও ইঙ্গিতও পাই। এখানেই কবিতার এবং আমাদের বোধের প্রগতি।

পাদটীকা

To Helen
Helen, thy beauty is to me
Like those Nicéan barks of yore,
That gently, o'er a perfumed sea,
The weary, way-worn wanderer bore
To his own native shore.

On desperate seas long wont to roam,
Thy hyacinth hair, thy classic face,
Thy Naiad airs have brought me home
To the glory that was Greece,
And the grandeur that was Rome.

Lo! in yon brilliant window-niche
How statue-like I see thee stand,
The agate lamp within thy hand!
Ah, Psyche, from the regions which
Are Holy-Land!

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর