নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তার সাহিত্যের হাতেখড়ির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটা গল্প উল্লেখ করেছেন। গল্পের নাম মেটামরফসিস। মার্কেজের দাবি মতে, গল্পটির প্রথম লাইন পড়ার পরই তার খাট থেকে পড়ে যাবার যোগাড় হয়েছিল। এভাবেও যে গল্প শুরু করা যায়; সে সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না।
সেই গল্পটার লেখকের নাম ফ্রানৎস কাফকা। আধুনিক বিশ্বসাহিত্যে সবথেকে প্রভাবশালী এবং দুর্বোধ্য এক পথিকৃৎ। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকদের মধ্যেও একগাদা নাম পাওয়া যাবে; যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কাফকা দ্বারা অনুপ্রাণিত। অথচ কাফকার জীবন কিন্তু সুখের ছিল না।
কাফকার জন্ম ১৮৮৩ সালের ৩ জুলাই। বর্তমান চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগের মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে। ইউনিভার্সিটি অব প্রাগ-এ আইন নিয়ে পড়াশোনা করার পর এক বীমা কোম্পানিতে যোগ দেন। লেখালেখির কাজটা হতো মূলত সন্ধ্যার দিকে। ১৯২৩ সালের দিকে বার্লিনে সরে এসে পুরোদমে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। টিউবারকুলোসিস-এর শিকার হিসাবে অচিরেই পাড়ি জমাতে হয় পরপারে। বেশিরভাগ লেখাই প্রকাশনার মুখ দেখতে পায় তার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের হাত ধরে।
তখনকার অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্যের বোহেমিয়ার প্রাগে জন্ম নেওয়া কাফকা শৈশব থেকেই এক নির্মম বাস্তবতা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারের বড় সন্তান। ছোট দুই ভাই গেয়র্গ এবং হেনরিখ ছোটবেলাতেই মৃত্যুবরণ করে। কাফকার বয়স তখন মাত্র ছয় বছর। পরবর্তীতে সেই পরিবারে আরো তিনজন কন্যা যুক্ত হয়; যাদের সবাই মারা যান নাৎসিবাহিনীর হত্যাযজ্ঞে।
পিতামাতার সাথে কাফকার সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল না। গৃহিণী মা জুলি ঘর সামলাতেই নিজের সমস্তটা নিয়ে ব্যস্ত। পুত্রের লেখক হবার স্বপ্ন তার কাছে না পেয়েছে অর্থ, না পেয়েছে গুরুত্ব। বাবা হারম্যান ছিলেন বদরাগী আর আধিপত্যকামী মানসিকতার। নিজে সফল ব্যবসায়ী থাকলেও পুত্রের স্বপ্ন তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে থোড়াই।
আরো পড়ুন ➥ সারা জীবন একটি কাব্যগ্রন্থ পরিমার্জন করে গেছেন হুইটম্যান
কাফকার জীবন এবং লেখাগুলোতে তার বাবার দারুণ প্রভাব ছিল। একজন স্বৈরাচারী আর মাথা গরম পিতা, যার কাছে পুত্রের সৃজনশীলতার কোনো মূল্য নেই। কাফকা নিজেও বিশ্বাস করতেন, তার জীবনের বেশিরভাগ সংগ্রাম, সম্পর্কের নাটকীয়তা কিংবা অনুরূপ জীবন মূলত এসেছে পিতার সাথে জটিল সম্পর্কের সাঁকো বেয়ে। সাহিত্যে কাফকার চরিত্রগুলো প্রায়শ উর্ধ্বতন ক্ষমতার বিরুদ্ধে নেমে আসত।
কাফকার মাতৃভাষা ছিল জার্মান। নিজের চেক নাগরিকত্ব কিংবা ইহুদি উত্তরাধিকারের বাইরে তার সাংস্কৃতিক পরিচিতি জার্মান হিসাবেই গৃহীত হয়েছিল। হাইস্কুল শেষ করে ভর্তি হলেন চার্লস ফার্দিনান্দ ইউনিভার্সিটি অব প্রাগ-এ। রসায়ন পড়তে মনস্থ হলেও মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই আইন বিভাগকে বেছে নেন। তার এই পছন্দ পিতাকে তুষ্ট করে। কাফকাও সময় বের করতে সক্ষম হন শিল্প ও সংস্কৃতিতে মগ্ন থাকতে। ১৯০৬ সালে আইন থেকে ডিগ্রি নিয়ে বের হন।
১৯০৭ সালের শেষের দিকে একটি ইতালিয়ান বীমা কোম্পানিতে চাকুরি নেন। এই অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর নিজেকে দেবার মতো সময়টা পর্যন্ত পাওয়া যেত না। লেখালেখির জন্য সময় দেওয়া যেন সাধ্যের বাইরে। চাকুরিতে তাই এক বছরও টিকতে পারেননি। খুব দ্রুত বোহেমিয়ারই এক ইন্সুরেন্স ইনস্টিটিউটে যোগ দিলেন। এবার কিছুটা বেশি সময় দিলেন কাজে। ১৯১৭ সালের আগে পর্যন্ত তিনি স্থায়ীভাবে কাজ করলেন। এর পরপরই অসুস্থ হয়ে অবসরে যেতে বাধ্য হন একরকম।
কর্মজীবনে কাফকা ছিলেন মোটামুটি জনপ্রিয়। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন ধাঁধা আর জটিলতায় পরিপূর্ণ। ফলে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন থেকে বের হতে পারেনি তার প্রেমও। প্রেমিকা ফেলিস বুয়্যারের সাথে পরপর দুইবার বাগদান হলেও বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি সম্পর্ক। বরং বিচ্ছেদে সমাপ্তি ঘটাতে হয় দিন শেষে।
পরবর্তীতে আবার প্রেমে পড়েন ডোরা ডায়াম্যান্টের। কাফকা অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকলেও সেই ভাঙা শরীরেই দুইজন থিতু হন বার্লিনে। দিন যেতে থাকল, কাফকার বাড়তে থাকল অনিদ্রা, হতাশা, উদ্বেগ আর মাইগ্রেইনের সমস্যাগুলো।
কাফকা এবং ডোরা প্রাগে ফিরে আসেন। চিকিৎসার প্রচেষ্টায় ঘুরে আসেন ভিয়েনাতে। তারপরেও শেষরক্ষা হয়নি। ১৯২৪ সালের ৩ জুন অস্ট্রিয়ার কিয়েরলিংয়ে মৃত্যুবরণ করেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকথক।
লেখক হিসাবে কাফকার খ্যাতি এসেছে তার মৃত্যুর পরে। কাফকার জীবন ও দর্শন তার লেখার ছত্রে ছত্রে সাজিয়ে রাখা। ম্যাক্স ব্রড নামের এক পুরাতন বন্ধু তাকে সহযোগিতা করেছে ব্যাপকভাবে। মৃত্যুর আগে এবং পরে—দুই সময়েই।
তার সবথেকে জনপ্রিয় ছোটগল্প ‘দ্য মেটামরফোসিস’। ১৯১২ সালে লেখা এবং ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়। Mediation নামে একটা গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সাল নাগাদ। আরেকটি বিখ্যাত রূপক ‘দ্য ট্রায়াল’ লিখিত হয় ১৯১৪-১৫ সালের মধ্যে। যদিও তার শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে পড়ছিল। তারপরেও থামালেন না লেখালেখি। ১৯১৬ সালের দিকে শেষ হলো ‘The Judgement’-এর কাজ। এখানে যেন তিনি তার সাথে পিতার সম্পর্ককে কোনো রকম রাখঢাক ছাড়াই তুলে ধরলেন। প্রায় ভেঙে পড়া শরীর নিয়েই ১৯১৯ সালের শেষ দিকে সম্পন্ন করলেন In the Penal Colony এবং A Country Doctor নামের দুইটি অসাধারণ লেখা।
সময়টা ১৯২৪ সাল। তারপরেও টিকে আছেন কাফকা। লিখে ফেললেন A Hunger Artist. চারটি ছোটগল্পের সমন্বয়ে খুবই সংক্ষিপ্ত ও সমৃদ্ধ লেখা। আরো একটি ছাপ এই লেখায় স্পষ্ট। কাফকার জীবনের শেষ দিককার বৈশিষ্ট্য। শরীরে এক ঘাতক নিয়ে কতদিন নিজেকে ধরে রাখা যায়! জীবনের প্রতি বিরক্ত কাফকা ছেড়ে দিলেন তাই। বন্ধু ব্রডকে অনুরোধ করলেন তার অপ্রকাশিত লেখাগুলো পুড়িয়ে ফেলতে।
ভাগ্যিস ব্রড সেদিন বন্ধুর অনুরোধ অগ্রাহ্য করেছিলেন। অথবা চিনতে পেরেছিলেন তার হাতে আসা লেখাগুলোই ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীতে লেখকদের অনুপ্রেরণা যোগাবে। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হলো ‘The Trial’, আর পাঠকেরা যে সম্পূর্ণ নতুন এক স্বাদ খুঁজে পেল। দারুণভাবে সফল হলো উপন্যাসটি। জোসেফ কে নামে জনৈক ভদ্রলোককে নিয়ে গল্প আবর্তিত হয়েছে; যিনি তথাকথিত বিচার ব্যবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উপস্থাপন করছে নগ্ন সত্যকে।
উৎসাহিত হয়েই পরের বছর ব্রড ‘The Castle’ প্রকাশ করেন। আরো একবারের জন্য পাঠক উপস্থিত হলো আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য ও নোংরামির নগ্ননৃত্য দেখার মঞ্চে। নায়ক ‘কে’ এবং গ্রামের কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধানকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ঘটনার মূল আখ্যান। ১৯২৭ সালে ‘আমেরিকা’ প্রকাশিত হলে আরেক দফা আলোচনায় আসেন বোদ্ধামহলে। কার্ল রোসম্যান নামের এক ছোট্ট সহজ সরল বালক পিতা-মাতা কর্তৃক আমেরিকা প্রেরিত হলে কিভাবে পদে পদে শোষিত হয়; গল্পের উপজীব্য সেটাই। ১৯৩১ সালে ব্রড কাফকার যে ছোট গল্প প্রকাশ করে ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ নামে, তা মূলত লেখা হয়েছিল অন্তত ১৪ বছর আগে।
কাফকার মৃত্যুর সময় তার নাম পরিচিত ছিল কেবল ছোট্ট একটা পাঠক দলের কাছে। সাধারণ পাঠক কিংবা সে যুগের খ্যাতনামা সাহিত্যিকেরা তার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিল না মোটেই। তার মৃত্যুর পর যখন বন্ধু ব্রড এক এক করে লেখাগুলো প্রকাশ করা শুরু করেন; কাফকা যেন নতুন করে জন্ম লাভ করে সেদিন থেকে। তারপর আস্তে আস্তে যত দিন গেছে, তাকে নিয়ে পাঠক মহলেই কেবল জনপ্রিয়তা বাড়েনি, বেড়েছে বাঘা বাঘা পণ্ডিতের আনাগোনা। তার লেখা সেই যুগেই জার্মান সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
বিশ শতকের ষাটের দশকেও পূর্ব ইউরোপ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর শোষণের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়ে কাফকা যেন আবার নতুন করে প্রয়োজন হয়ে দেখা দিল পাঠকের কাছে। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নগ্নরূপ নিয়ে লিখিত গল্পের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে এলো এক নতুন ধারা—কাফকায়েস্ক।
কাফকার আবেদন উপলব্ধি করতে হলে কেবল একটা গল্প স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৮৮ সালে কাফকার নিজের হাতে লেখা এক পাণ্ডুলিপি নিলামে উঠল। আর কিছু না, The Trial গল্পের পাণ্ডুলিপি। আর তা বিক্রি হয়েছিল ১.৯৮ মিলিয়ন ডলারে। যে কোনো আধুনিক পাণ্ডুলিপির মধ্যে সবথেকে বেশি দামে বিক্রি হওয়া পাণ্ডুলিপি। কিনেছিলেন এক জার্মান। কেনা শেষ হলে তার মতামত ছিল, “এটি বিশ শতকের জার্মান সাহিত্যের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। জার্মানিকেই এটা রাখতে হবে।”