শক্তিশালী ও কালোত্তীর্ণ লেখকের অনেক রকম গুণ থাকে। বিভিন্নভাবে তাদের পরিচয় প্রকাশিত হতে পারে। তারা পুরস্কার ও পাঠকপ্রিয়তায় ধন্য হতে পারেন বা না-ও হতে পারেন। তবে তাদের থাকে এমন এক সামর্থ্য, যা অভূতপূর্ব। আফ্রিকার আধুনিক সাহিত্যের জনক চিনুয়া আচেবির লেখায় আছে তেমনি শক্তিমত্তা। 'তার লেখা কারাগারের দেয়ালও ভেঙে দেয়' বলে মন্তব্য করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।
চিনুয়া আচেবির নাম আমরা জানি তার বিখ্যাত উপন্যাস 'থিংস ফল অ্যাপার্ট'-এর মাধ্যমে। আফ্রিকার রাজনীতি ও পশ্চিমাদের চোখে আফ্রিকা যেভাবে চিত্রিত হয় সে প্রসঙ্গটি ঘুরে ফিরে এসেছে চিনুয়া আচেবির রচনায়। আফ্রিকার অনেক লেখকের প্রেরণার উৎস তিনি। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত তার এই প্রথম উপন্যাস গ্রন্থটি এক ঝটকায় স্বীকৃতি পায় 'মর্ডান আফ্রিকান মাস্টারপিস' হিসাবে। বইটি অনূদিত হয়েছে বিশ্বের পায় সবগুলো ভাষায়।
১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর জন্ম গ্রহণকারী এ লেখক বেঁচে থাকলে ৯০ বছরের প্রান্তসীমা স্পর্শ করতেন। কিন্তু তাতে কোনও সমস্যা হয়নি। নোবেল সাহিত্য পুরস্কার না পেয়েও তিনি মর্ডান আফ্রিকান সাহিত্যের পুরোধা এবং জীবন্ত আইকন। এমনকি, আফ্রিকা থেকে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া ওলে সোয়িংকা (নাইজেরিয়া, ১৯৮৬), নাগিব মাহফুজ (মিশর, ১৯৮৮), নাদিন গার্ডিমার (দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯৯১)-এর চেয়ে কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাকেই অগ্রগণ্য রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বই ও লেখালেখির বাইরে চিনুয়া আচেবির কথা আলোচনা হয়েছে সহকর্মী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও সিনিয়র প্রফেসর ড. মহিবুল আজিজের সঙ্গে, যিনি আচেবির প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে ধন্য। আমরা একমত হয়েছি যে, আফ্রিকান ফেনমেনন তার মতো আর কেউ আধুনিকতমভাবে তুলে ধরতে পারেননি।
আরও পড়ুন: মহীবুল আজিজের সৃজন জগৎ
দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার ইকবো শহরে জন্ম নেয়া আচিবে আফ্রিকাকে নিয়ে রচনা করেছেন স্মরণীয় উপন্যাসমালা, যাকে অভিহিত করা হয় 'আফ্রিকান ট্রিলজি' নামে। সব লেখায় আফ্রিকান সমাজ, সংস্কৃতি ও মানবগোষ্ঠীর প্রপঞ্চ নিয়ে কাজ করছেন তিনি। গভীরতমভাবে ছুঁয়েছেন জন্মভূমি আফ্রিকা নামক নির্যাতিত মহাদেশকে।
হতে চেয়েছিলেন চিকিৎসক, আচিবে হলেন শিক্ষক ও লেখক। ইউরোপে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা থাকলেও ১৯৯০ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে আসছিলেন তিনি মৃত্যুর পূর্ব-পর্যন্ত ( ২১ মার্চ, ২০১৩)।
আহত হওয়ার পর থেকে তিনি কোনও বই লেখেননি। তার পরবর্তী বছরগুলো বেশিরভাগই কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে। চাকরি জীবনে তিনি নাইজেরিয়ার ব্রডকাস্ট সার্ভিসে কাজ শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই তার লেখালেখি শুরু হয়।
লেখক হিসাবে চিনুয়া আচেবি আফ্রিকা এবং পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করেছিলেন। তার কাজকে মানদণ্ড ধরেই প্রজন্মান্তরে আফ্রিকান লেখকদের কাজের মূল্যায়ন হয়ে আসছে। চিনুয়া ২০ টিরও বেশি লেখা লিখেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি লেখাই রাজনীতিবিদ এবং নাইজেরিয়ার নেতাদের নেতৃত্বে ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করে লেখা। তার বইগুলোতে দেশটির ঔপনেবেশিক সময়ে ইবো সমাজের ঐতিহ্য, দেশটির সংস্কৃতিতে খ্রিষ্টানদের আগ্রাসন এবং আফ্রিকা ও পশ্চিমাদের মধ্যকার প্রথাগত দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে এসেছে। এছাড়াও তিনি অনেক ছোটগল্প, শিশু সাহিত্য এবং প্রবন্ধও রচনা করেছেন।
১৯৫৮ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' এর সুবাদে ব্যাপক পরিচিত লাভ করলেও আচেবির জনপ্রিয়তায় কখনোই ভাটা পড়েনি। সব সময়ই তিনি ছিলেন সেলিব্রিটি। তবে একথা ঠিক যে প্রথম উপন্যাসেই তিনি প্রবলভাবে আলোচিত হন, যে উপন্যাসটি অনুবাদ হয়েছে ৫০ টিরও বেশি ভাষায়। তাছাড়া, বিশ্বজুড়ে উপন্যাসটি প্রায় ১ কোটি কপি বিক্রি হয়। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস 'অ্যান্টহিলস অফ দি সাভানা' প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে।
চিনুয়া আচিবের লেখা রাজনৈতিকভাবে অবদমিত মানুষের সংক্ষোভকে জাগরিত করে। মননে ও চেতনায় দ্রোহের স্পন্দন জাগায়। চিরনিপীড়িত আফ্রিকার জীবনবাদী উন্মেষের সূত্রকে তিনি নান্দনিক বিভায় তুলে ধরেন উপন্যাসের কাঠামো ও আখ্যানে। কারাগারের দেয়াল ভেঙে দেয়ার মতো শৌর্যময় লেখার রূপকার তিনি।