মাহবুবুল হক শাকিল একজন প্রাণবন্ত মানুষ, যে সব সময় জীবনটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করত। সম্পর্কে আমার বন্ধু ও ছোট ভাই। একটি অসাধারণ সম্পর্ক। বহুদিন ধরেই পরিচয় কিন্তু ঘনিষ্ঠতা হয় ২০০৯ সাল থেকে যখন সে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হিসাবে দায়িত্ব পায়। পেশাগত বিভিন্ন কারণে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়, এবং সেখান থেকেই ভাই আর বন্ধু হিসেবে যাত্রা শুরু।
তার আড্ডায় গুণীজনদের ভিড় থাকত, সেই আড্ডা থেকেই লেখক, সাহিত্যিক, কবি, আবৃত্তিকারদের সাথে পরিচিতি হয়। খুব কম মানুষেরই এমন একটি গুণী সার্কেল হয়।
যেটা খুব মনে পরে এখন, শাকিলের সাথে যখনই দেখা হতো, একটি অদ্ভুত উষ্ণতায় আমাকে জড়িয়ে ধরত এবং আমার কপালে একটি চুমু দিত। এই চুমা দেওয়া নিয়ে অনেক হাসাহাসিও হয়েছে, তার জবাবে শাকিল বলত, নাদীম ভাই তোমার সরলতা ও অমায়িক ব্যবহার আমার হৃদয়ে এক অদ্ভুত জায়গা করে নিয়েছে। এরই বহিঃপ্রকাশে আপনাকে আমি সব সময় এইভাবেই অভিনন্দন জানাই।
এত কবিতা আর সাহিত্যের চর্চা ছিল তার যে অহরহই বিভিন্ন বই আর লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে তার মনের কথা বোঝাত, এর মধ্যে বের হলো তার দ্বিতীয় কবিতার বই “মন খারাপের গাড়ি”, বেশ কয়েকটা কবিতা পড়ে মনে হলো তার নিজের জীবনের কথা বলার চেষ্টা করেছে। ভলোবাসা বা ভালোবাসা না পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। তার জীবনে অনেক আনন্দ ও অনেক কিছু প্রাপ্তির থাকার পরেও কোথায় যেন একটি শূন্যতা ছিল। আমি বুঝতাম, কিন্তু কখনো ওর কষ্ট নিয়ে কোনো কথা বলিনি, যদি ওর কষ্টটা আরও বেড়ে যায়!
সবসময় মানুষের উপকার করতেই আমি দেখেছি, গুলশানের সামদাদো জাপানিজ রেস্টুরেন্ট ছিল তার সন্ধ্যার ঠিকানা। বন্ধু-বান্ধব এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা এখানেই আড্ডা জমাত। শাকিল অনেক গণ্যমান্য বন্ধুদের এখানে ডেকে এনে খাওয়াত।
একটি গুজব বাজারে ছড়াল আমাকে নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বিশেষ চাকুরি দিয়ে বিদেশ পাঠাবে, আমি তখনই চিন্তা করলাম একমাত্র শাকিলই বলতে পারবে এই গুজবের সত্য-মিথ্যা। ফোন করলাম এবং সামনাসামনি দেখা হবার পর জিজ্ঞেস করলাম, উত্তরে বলল “নাদীম ভাই আমি তো এমন কিছু শুনিনি।”
কিন্তু যখন আমি জানতে পারলাম, লন্ডন হাইকমিশনে আমাকে প্রেসমিনিস্টার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তখন আমি শাকিলকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সত্যিই জানতেন না! তারপর শাকিল একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “আপা যখন জিজ্ঞেস করল আপনার কথা, আমি তখন ১০০% আপনার পক্ষে ভোট দিয়ে বলেছিলাম, নাদীম ভাই পারফেক্ট চয়েজ এই কাজের জন্য।” তখন আমি বুঝলাম, এই চাকুরির জন্য বহু মানুষ লবিং করে থাকে, কিন্তু তা আমার ভগ্যে জুটেছে শাকিলের মতো কিছু মানুষের জন্য।
আমি একবার লন্ডন থেকে একটি প্রয়োজনে ঢাকা এসছিলাম। তার পরদিন রাতে শাকিলের সাথে আমার খাওয়ার কথা, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য সেই রাতের খাওয়া আর হলো না। কারণ শাকিল ঠিক পরেরদিন দুপুরেই আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল চির শান্তির দেশে। তখনই আমার মনে হয়েছিল আমার বিপদেও সময় পাশে থাকার মতো কেউ নাই। তাও সত্য প্রমাণিত হলো। একটি মহাবিপদ হলো এবং এর পেছনে যে ছিল তার কথাই শাকিল আমাকে লন্ডনে থাকতে অনেকবার বলেছিল।
গত বছর লন্ডনের চাকুরি শেষে ঢাকায় এসে ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম শাকিলের সাথে দেখা করতে। কবরস্থানে ঢুকে ডানদিকেই শাকিলের সমাধিস্থল। এখানে দাঁড়িয়ে ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল, শাকিল ওখানে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে। আমি বললাম, “শাকিল তুমি নেই বলেই, লন্ডনে যখন আমার থাকা দরকার ছিল আপা এবং আমাদের দেশের জন্য, কিন্তু কিছু কুচক্রিদের জন্য চলে আসতে হলো। আমি জানি আল্লাহ তোমাকে অনেক ভালো রেখেছেন, তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে দোয়া রইল, তুমি ছিলে, আছো এবং চিরদিন আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে, ভালো মানুষের কখনো বিদায় হয় না।”
নাদীম কাদির
সাংবাদিক, লেখক এবং টিভি ব্যক্তিত্ব