উত্তর ভারত ঘুরে: ষোড়শ শতকে শুরু হয়ে (৩০ এপ্রিল, ১৫২৬) উনিশ শতকে সমাপ্ত (১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৭) কয়েক শতাব্দী ব্যাপী মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে মাত্র ১৪ বছর রাজধানী ছিল ফতেহপুর সিক্রি। সে আমলে রাজা-বাদশাহের খেয়াল-খুশির অন্ত ছিল না। আর সেসব ছিল বড়ই বিচিত্র ও সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের চেয়ে অনেক আলাদা। ফতেহপুর সিক্রিতে মিশে আছে সেইসব রাজসিক খেয়ালের খানিকটা ঝলক।
স্বল্প জীবনপ্রাপ্ত হলেও ফতেহপুর সিক্রির দীর্ঘ ইতিহাস ও তাৎপর্য রয়েছে। ১৫৭১ সালে এখানে রাজধানী বানিয়ে তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালেই তা সরিয়ে নেন। ১৬১০ সালে শহরটি সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হয়। পরিত্যক্ত হয়ে নিঃসঙ্গ ভাবে পড়ে থাকে বিশাল স্থাপনাসমূহ, যা এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।
রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি ফতেহপুর সিক্রির সঙ্গে মিশে আছে আধি ভৌতিক রহস্যময়তা। টুপটুপ বৃষ্টিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন রাজধানীর পাদদেশে দাঁড়াতেই সেই পরশ এসে শরীরে লাগলো। ততক্ষণে বৃষ্টির আঁচ কমে এসেছে। পায়ে পায়ে ফতেহপুরের ভেতরে প্রবেশের সময় এর অতীত ও ইতিহাসের কথাগুলো সঙ্গী হলো।
সম্রাট আকবর এখানে রাজধানী স্থাপন করার আগে এখানে সিক্রি নামের একটি গ্রাম ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর এ জায়গাটি চিনতেন এবং পছন্দও করতেন। ফলে জায়গাটি মুঘলদের কাছে অচেনা-অজানা ছিল না। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, সিক্রি নামটি সম্রাট বাবরের দেওয়া। বাবর এই এলাকটিকে বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্য অনেকবার ব্যবহার করেছিলেন এবং সিক্রির নিকটবর্তী সীমান্তে রাজস্থান-পাঞ্জাব থেকে আগত মহারাজা রানা সংগ্রাম সিংহের বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন।
বাবরের জীবনীকার বেভারেজ লিখেছেন, রানা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করে বাবুর এখানে ‘ফতেহবাগ’ বা ‘বিজয় উদ্যান’ নামে একটি বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্য এশিয়ান মুঘলদের উদ্যান প্রীতি ছিল সর্বজনবিদিত। তারা যেখানেই কর্তৃত্ব করেছে, সেখানেই সুপরিকল্পিত বাগান বা উদ্যান বানিয়েছেন। বাগানকে তারা বলতেন ‘গুলিস্তাঁ’। আগ্রার চারদিকে শত শত বছর পরেও ছড়িয়ে আছে মুঘলদের উদ্যান প্রেমের চিহ্ন। দিল্লি, ঢাকা, কাশ্মীর, লাহোর, সর্বত্র মুঘল-প্রতিষ্ঠিত বাগানের দেখা পাওয়া যায় এখনো।
ফতেহপুরে বাবুরের বাগান সম্পর্কে তার কন্যা ও সম্রাট হুমায়ূনের জীবনী ‘হুমায়ূননামা’র রচয়িতা গুলবদন বেগম লিখেছেন, ‘বাবুর সেই বাগানে একটি আটকোণা চাতাল বানিয়েছিলেন, যা তিনি বিনোদন ও লেখার কাজে ব্যবহার করতেন। তিনি নিকটবর্তী ঝিলের মাঝখানে একটি বেদীও নির্মাণ করেন।
সম্রাট আকবর রাজধানী বানানোর সময় (১৫৭১) এর কোনও নামকরণ করেন নি, ‘ফতেহপুর’ বা ‘বিজয়ের শহর’ নামটি দিয়েছেন ১৫৭৩ সালে গুজরাট জয় উপলক্ষে। তারও আগে, ১৫৬৯ সালে বেশ পরিণত বয়সে এই স্থানে এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে আকবরের ঔরসে। আগে থেকেই এখানে শেখ সেলিম চিস্তি নামে একজন বুজুর্গ পীরের খানকাহ বা আশ্রম ছিল এবং পীরের দোয়ায় আকবর পুত্রসন্তান লাভ করেছিলেন বলে পুত্রের নামও রাখা হয় পীরের নামানুসারে। সেলিম, যিনি পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে খ্যাত। জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় জন্মদিনে আকবর এখানে রাজধানী নির্মাণ শুরু করেন।
জয়পুর-আগ্রা হাইওয়ে থেকে ডানে মোড় দিয়ে যে গলিপথ, তাতে কিছুদূর এগিয়ে আবার ডানে কিঞ্চিত উপরের দিকে উঠতে হয় ফতেহপুর সিক্রিতে যেতে। আকবর বাদশাহের এই রাজধানী নগরীটি কিছুটা উচ্চভূমিতে অবস্থিত। নগরের প্রবেশের মুখেই ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ নামে বিশাল গেট। মধ্যযুগের বিবেচনায় সুবিশাল তোরণে এক সুপরিকল্পিত নগরীর প্রাচীন আবছায়া ভেসে আসে প্রথম দর্শনেই। মুঘল পূর্ব-পুরুষ তৈমুর লং প্রচলিত পারসিক আদালতের আদলে আকবর এটি নির্মাণ করতে চাইলেও এতে স্থানীয় স্থাপত্যরীতির মিশেল হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। পার্শ্ববর্তী রাজস্থানে প্রচুর ও বিচিত্র বেলেপাথর থাকায় ভেতরের অট্টালিকাগুলো পাথুরে এবং অধিকাংশই লালচে রঙের।
মুঘলরা ভারতকে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও স্থাপত্য উপহার দিয়েই শেষ করেনি, আয়ের পথও খুলে দিয়ে গেছে। টিকেট কেটে ঢুকতে হচ্ছে এসব স্থাপনায়। এতে ভারতীয়দের জন্য টিকেটের দাম কম হলেও বিদেশিদের জন্য যথেষ্ট উচ্চমূল্য। তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট, কুতুব মিনারসহ বিভিন্ন মুঘল ও মুসলিম স্থাপনায় লক্ষ লক্ষ পর্যটক কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে ভারত সরকারের তহবিলে। টিকেটের পাশাপাশি দালাল ও গাইডের লম্বা বহর। সব কিছু জানিয়ে দেওয়ার জন্য পিছু নেয় তারা। ভারতের মুঘল ঐতিহ্য এমনই এক নিঃশেষ না হওয়া বিষয়, যা এখনো খুলে রেখেছে রোজগারের পথ!
বৃষ্টির কারণে ফতেহপুর সিক্রিতে ভিড় কম। দালাল ও গাইডরাও তেমন নেই। ড্রাইভার সুরজিৎ সঙ্গী হলো। রাজপুত যুবক এ পথে পর্যটক আনা-নেওয়া করতে করতে ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্থান-কাল সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল। যথারীতি ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ দিয়েই প্রবেশ করি আমরা। তবে ‘বাদশাহী দরওয়াজা’ নামে আরেকটি প্রবেশদ্বারও রয়েছে। লাল-হলুদ বেলে পাথরে নিমির্ত ফটকে সাদা-কালো মার্বেল দিয়ে নকশা করা। মাটি থেকে ৫৪ মিটার লম্বা দরওয়াজা পর্যন্ত পৌঁছাতে ৪২টি সিঁড়ির ধাপ উঠতে হলো। দরজার পাল্লাগুলো কাঠের কারুকাজ করা এবং এর মাথায় এক সারি প্যারাপেট ও পেছনে তিনটি ছত্রী রয়েছে। মূল দ্বারের দেওয়ালে খোদাই করা আছে ধর্মকথা, যাতে এক বিশ্বের নশ্বরতার উল্লেখ করে অবিনশ্বর সৃষ্টিকর্তার গুণকীর্তন করা হয়েছে। বুলন্দ বা সুমহান নামে খ্যাত প্রবেশ তোরণে সৃষ্টিকর্তার মহিমাব্যঞ্জক বাণীই স্বাভাবিক।
ফতেহপুরের ভেতরে প্রাসাদ প্রাঙ্গণ, যেখানে জ্যামিতিক ভাবে সজ্জিত বেশ কিছু চাতাল দেখা গেলো। রয়েছে পীর সেলিম চিস্তির মাজার শরিফ। দুর্দান্ত শিল্প ভাবনা ও নান্দনিক স্থাপত্যের ফতেহপুর সিক্রির চারদিকে তাকিয়েই নিজের বোকামির জন্য লজ্জিত হলাম। বৃষ্টি সিক্ত বিরূপ আবহাওয়া আর স্বল্প সময় নিয়ে এখানে আসার কোনও মানেই হয় না। পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে অনুসন্ধান করে দেখতে হলে দীর্ঘ সময় নিয়ে এখানে আসাই শ্রেয়। তা না হলে দুই মাইল লম্বা ও এক মাইল চওড়া প্রাসাদ আর প্রাঙ্গণ দেখা মোটেও সম্ভব নয়।
পুরো ফতেহপুর সিক্রি পাঁচ মাইল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মনে করা হয়, রাজপুত, জাঠ, মারাঠা, শিখ আক্রমণের কারণে শহরটিকে দূর্গ-সদৃশ করা হয়েছে। আগ্রা দূর্গও তেমনি। রাজস্থানেও দূর্গ শহর দেখেছি। মধ্যযুগের শহরগুলো সামরিক নিরাপত্তার কারণে সুদৃঢ় প্রাচীর বেষ্টিত দেখতে পাওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শত শত বছর পরেও প্রাচীর বেশ মজবুত ও সুরক্ষিত।
সুললিত ও সুসজ্জিত ফতেহপুর আবাসস্থল দেখে মুঘলদের পরিচ্ছন্ন রুচি ও গুছানো প্রশাসনিক কার্যক্রমের নমুনা বোঝা যায়। রাষ্ট্রীয় কাজ, বসবাস ও অন্যান্য তৎপরতায় জীবনকে চমৎকার অবকাঠামোয় প্রবাহিত করেছিলেন মুঘলরা। তৎকালের পশ্চাৎপদ ভারতে সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, খাদ্য, উন্নত প্রশাসনের পাশাপাশি দিয়েছিলেন স্থাপত্য সুষমায় বিস্তৃত বসবাসের আমেজ।
হাতের সময়কে যথাসম্ভব কাজে লাগানোর পরও ফতেহপুর সিক্রি পুরো ঘুরে না দেখার অতৃপ্তি নিয়ে ফিরতে হলো। ভেতরে অনেক ছোট বড় স্থাপনা, মহল, প্রাঙ্গণ এবং এসবের ইতিহাস ও শিল্প গুণ পরখ করে দেখার জন্য পুরো একটি দিনও মনে হয় যথেষ্ট নয়। অনুচ্চ ফতেহপুর সিক্রির চারপাশে প্রসারিত বিশাল ভারতের সবগুলো দিক, যেখানে বসে মধ্য এশিয়ার পারস্য-তুর্কি-মোঙ্গল শিল্প ঐতিহ্যের ভারতীয় সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুঘলরা।
মুঘলরা কয়েক শত বছর ভারত শাসন করে চুঘতাই তুর্কি ও পার্শি ভাষা ও সংস্কৃতি ছেড়ে হিন্দি ও উর্দুর সঙ্গে এদেশীয় অনেক কিছুই নিয়েছিলেন তথাপি ফতেহপুর সিক্রিতে দাঁড়িয়ে মনে হলো, তারা ছিলেন মিলনের দূত। তারা না ছিলেন বিদেশি, না ছিলেন এদেশীয়। তারা ছিলেন এ উপমহাদেশে সংস্কৃতি, শিল্পকলার সমন্বয়ের প্রতীক। উন্নত সকল কিছুর মিশ্রণে ভালোবাসার ভারতে তারা সাজিয়ে ছিলেন।
মুঘলরা একই সঙ্গে তৈমুর ও চেঙ্গিস খানের বংশধারার ঐতিহ্য বহন করলেও তাদের ধমনীতে মিশেছিল এদেশের রক্ত। এজন্যই তারা ছিলেন দেশজ কাঠামোতে উত্তর-পুরুষের ঐতিহ্যের সমন্বয়ক। ইতিহাস বলে, শুধুমাত্র বাবুর ও হুমায়ূন ছিলেন প্রকৃত মধ্য এশীয়। আকবর ছিলেন পার্সিয়ান হামিদা বানুর গর্ভজাত অর্ধেক ইরানি। মাতা যোধাবাঈ’র কারণে জাহাঙ্গীর ছিলেন অর্ধেক রাজপুত।পূর্বের বাংলা থেকে পশ্চিমের কাবুল আর উত্তরের কাশ্মীর থেকে দক্ষিণের কাবেরী নদী পর্যন্ত শাসন করেছিলেন তারা সমন্বয় ও মিলনের মাধ্যমে। ৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার জায়গায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষকে নিয়ে যে সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে মুঘলরা শাসন করেছিলেন, তা ছিলো তৎকালীন বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ এবং সমৃদ্ধতম দেশ, যার অপসৃয়মান ঝলক এখনো মিশে আছে আগ্রা, দিল্লি, লাহোর, ঢাকা এবং সংক্ষিপ্ততম রাজধানী ফতেহপুর সিক্রির সুনিপুণ বিন্যাসে।
ফতেপুর সিক্রির শান বাঁধানো চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে অতীত ঐতিহ্যের সেইসব কথা প্রতিধ্বনি তুলে। বার বার মনে জাগে, শ্রেষ্ঠ মুঘল সম্রাট ও নগরের গোড়াপত্তনকারী আকবরের কথাও। স্বল্প সময়ের রাজধানী হলেও ফতেহপুর সিক্রিতে আকবর তার অভিনব দ্বীন-ই-ইলাহি বিষয়ে নানা ধর্মের পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনায় মত্ত হতেন। নিঃসন্তান আকবরের শেষজীবনে একমাত্র পুত্রও পির সেলিম চিস্তির দোয়ায় ভূমিষ্ঠ হয় ফতেহপুরের মাটিতে। আর এখানেই পরবর্তীকালে শেষ দিকের মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহ তার প্রতিনিধি সৈয়দ হাসান আলি খানকে হত্যা করা হয়। মুঘলরা দুর্বল হলে এই পরিত্যক্ত রাজধানী কখনো মারাঠা, কখনো রাজপুত, জাঠ বা শিখ জাতির দখলে আসে। সর্বশেষে ইংরেজরা ভারত দখল করলে তারা এখানে গড়ে সেনা ছাউনি। এতো কিছুর হয়েছে সংক্ষিপ্ত রাজধানী শহরে, যাতে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পাশাপাশি রয়েছে আনন্দ ও বেদনার অশ্রু। বৃষ্টিভেজা ফতেহপুর সিক্রি ঘুরে ফিরে আসার সময় সেসব কথাই বার বার মনে দোলা দেয়।