শিশু কিশোরদের জন্য প্রকাশিত একটি বইয়ের ভূমিকায় হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন “এই পৃথিবীতে আমার সবচে’ প্রিয় দুটি জিনিসের একটি হচ্ছে জোছনা রাত। অন্যটি শিশু।” সেই শিশুদের জন্য হুমায়ূন আহমেদ না লিখে থাকেন কিভাবে? যতদূর জানি শিশুকিশোরদের জন্য হুমায়ূন আহমেদের প্রথম লেখা—নীলহাতী। এরপর অনেকদিন লেখেননি শিশুদের জন্য। নীলহাতী প্রকাশিত হবার পর আবার যখন শিশুদের জন্য লিখলেন ততদিনে এগার বছর পার হয়ে গেছে। মাঝখানে এই এগার বছর শিশুদের জন্য না লিখবার কারণটি ছিল নাকি বইটি বিক্রয় বেশি না হওয়া। দু’হাজার কপি ছাপা হয়েছিল তখন। কিন্তু দশ বছর পর খোঁজ নিয়ে জানা গেল অর্ধেকের বেশি কপি গুদামে পড়ে আছে। তাই মন খারাপ করে নাকি লেখেননি। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় “যাদের জন্য লেখা তারাই যদি না পড়ে তাহলে কী হবে লিখে? মাঝে মাঝে খুব লিখতে ইচ্ছে করত। তখন করতাম কি, গল্পগুলি আমার বাচ্চাদের বলতাম।”
নীলহাতী প্রকাশিত হবার এগার বছর পর হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন—‘তোমাদের জন্য রূপকথা’, ‘পুতুল’, ‘সূর্যের দিন’। শিশু পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল—‘বোতলভূত’ উপন্যাসটি। প্রতিটি লেখা যে এখনো শিশু কিশোরদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় তা বলাই বাহুল্য। শিশুরা যখন কোনো বই পড়ে তখন তার লেখক কে, কী তার পরিচয়, তিনি বড়দের লেখক না ছোটদের লেখক এসব না জেনেই পড়ে। সেটাই স্বাভাবিক। আমার শৈশবেও তাই হয়েছিল। আমার প্রথম পঠিত বইটি ছিল ‘বোতলভূত’। প্রতিবেশি বন্ধুর বাসায় প্রথম দেখেছিলাম বইটি। ওই সময় ভূত নিয়ে নানারকম ফ্যান্টাসি কাজ করত। বইটি পড়তে পড়তে ভেবেছিলাম সত্যি সত্যি কি বোতলের ভেতর ভূত পাওয়া যায়। ইশ, আমার যদি একটা থাকত। কিন্তু বইয়ের শেষে ভূতের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেন লেখক। আসলে বোতলের ভেতর কোনো ভূত ছিল না। গল্পে কাল্পনিক ভূতের সাহায্যে যেসব কাণ্ড ঘটেছে সবই কাকতালীয়।
এরপর, হুমায়ূন আহমেদের যে বইটি পড়েছিলাম সেটি ‘পুতুল’। অমর একুশের গ্রন্থমেলার স্টল থেকে আমার কেনা এটিই ছিল প্রথম কোনো বই। হুমায়ূন আহমেদের পুতুল বইটি কয়েকবার পড়েছিলাম। আমার ছেলেবেলার বয়সে পুতুল বইটিকে আসলেই ‘কষ্টের’ মনে হয়েছিল। পুতুল ধনী বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। অসুস্থ থাকার কারণে ওকে গৃহবন্দীর মতো জীবন যাপন করতে হতো। আর দশটা স্বাভাবিক ছেলেমেয়ের মতো ছিল না ওর জীবন যাপন। আর ব্যস্ত বাবা মাকেও সে খুব কম সময়ই কাছে পেত। একদিন ঘটনাচক্রে পুতুল বাড়ির বাইরে চলে আসে, আর পথ ভুলে হারিয়ে যায়। দুইজন টোকাই ছেলেমেয়ের সাথে ওর পরিচয় হয়। ওরা ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে চায়, এবং পৌঁছেও দেয়। কিন্তু এর আগেই পুতুল—জীবনের অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। জীবনকে সে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করে।
বোতলভূত, পুতুল ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের শিশু কিশোরদের উপযোগী আর যে উপন্যাসের কথা এখন মনে পড়ছে সেগুলো হচ্ছে ‘নুহাশ এবং আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ’, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা ‘সূর্যের দিন’ এবং রহস্য উপন্যাস ‘অন্যভুবন’। শিশুদের জন্য আরেকটি উপন্যাস ‘হিমু মামা’। হুমায়ূন আহমদের সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্রকে নিয়ে লেখা এই বইটিতে কোথাও হিমু চরিত্রটি নেই কিন্তু উপন্যাসের ঘটনা আবর্তিত হয় ‘হিমু’কে ঘিরেই। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৪ সালে। বইটিতে ‘শুভ্র’ নামের একটি ছেলে যে ‘হিমু’ হওয়ার চেষ্টা করে এবং তা করতে গিয়ে বিভিন্ন মজার ঘটনা ঘটায়। শুভ্রের ভাগ্নে ‘টগর’ এসব ঘটনা ডায়েরিতে লিখে রাখে; আর এখান থেকেই বইটির নাম দেয়া হয়েছে ‘হিমু মামা’। আমার খুব মনে আছে, আমার ছোটভাই সেবার মেলায় ৫০ টাকা জমিয়ে রেখেছিল শুধু এই বইটি কেনার জন্য। ওই সময় সব ছোট ছেলেমেয়েরা খোঁজ খবর রাখত এবারের মেলায় হুমায়ূন আহমেদের নতুন কী বই এলো। বড়দের জন্য বেশি লিখলেও ছোটরাও তার দারুণ ভক্ত—তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষার পাশাপাশি নানান মজার মজার কাণ্ড ও প্রচুর হাস্যরস ও উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দেয় ছোটদের উপযোগী এই বইগুলির চরিত্ররা। ‘গোবরবাবু’, ‘বোকা দৈত্য’, ‘আকাশপরী’, ‘জাদুকর’, ‘বনের রাজা’—এমন বেশকিছু মজার ছোটগল্পও আছে। যেখানে রূপকথা, কল্পনার সাথে সাথে বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার। আবার বিজ্ঞান জানার ফলে বৈজ্ঞানিক অনেক তথ্যও কৌশলে প্রবেশ করেছেন তিনি এই লেখাগুলোতে। এসবের মধ্য দিয়ে শিশু মনকে তিনি সূক্ষ্ম অথচ সঠিকভাবেই উন্মোচন করেছিলেন।
এ যুগের শিশু-কিশোর যারা ইন্টারনেট, গেমস আর স্মার্টফোন নিয়ে বেশি মজে থাকে তাদের হাতে যদি হুমায়ূন আহমেদের এই গল্পগুলি তুলে দেওয়া যায়, আমার বিশ্বাস কিছু সময়ের জন্য হলেও ওরা অন্য এক ভুবনের স্বাদ পাবে। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, শিশুদের জন্য তার লেখার মূল কারণ তার নিজের ছেলেমেয়েরা। সারাক্ষণ নাকি ওরা বায়না করত, আমাদের জন্য লিখতে হবে। লিখতেই হবে। অন্যদিকে ঘটনাবহুল এক শৈশবও তার ছিল।
আমজনতার পাশাপাশি শিশুদের সাইকোলজিও যে হুমায়ূন আহমেদ সফলভাবে ধরতে পেরেছিলেন তা বোঝা যায় তার কিশোর সমগ্রের মুদ্রণ সংখ্যা দেখে। বহু পুরস্কারে ভূষিত হলেও কিশোর সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য পেয়েছিলেন ‘অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার’। ছোটদের জন্য লেখাগুলো এমন যে ছেলে-বুড়ো যে কোনো বয়সের মানুষকেই তা আনন্দ দেয়। এখানেই হুমায়ূন আহমেদ ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে আমাদের কাছে ধরা দেন। বিশেষভাবে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা সাহিত্যেই হুমায়ূন আহমেদ অবচেতনভাবেই কিনা জানি না—বিশেষ সতর্কতার সাথে শিশু-কিশোরদের মনকে তিনি আবিষ্কার করেছেন যেন তিনি শিশুদের মনের কথাই বলছেন—এখানেই হুমায়ূন আহমেদের শিশুসাহিত্যের সার্থকতা। বড়দের জন্য বেশি লিখলেও এবং সেগুলো সুখপাঠ্য হলেও বারবার পড়তে ইচ্ছে করে হুমায়ূন আহমেদের শিশুসাহিত্যগুলোই।