তুষার কবিরের একগুচ্ছ কবিতা

কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

তুষার কবির | 2023-08-29 15:05:05

বীণা

রক্তচন্দনের বনে—বুঝি হারিয়ে ফেলেছি সেই নোটবুক—যার শাদা পাতা জুড়ে লেখা ছিল সুরহীন ঘুমের মল্লার। পাখোয়াজ ভাঁজ খুলে দেখি তোমার হারানো বীণা বেজে ওঠে কার্নিশের রেখাপথে।
এই বসন্ত দুপুরে, মৃদু হাতে সুর তুলে কে বাজিয়ে যায় দরবার-ই-কানাড়া? ঘরভর্তি নিমের সুবাসে আসে দখিনের মাতাল হাওয়া। তুমিই তবে এই কুরুক্ষেত্রে লিখে চলেছো যত দুঃখগাথা—গোধূলির ধূলিওড়া পথে?
ধূলিখামে চিঠি আসে—দুই কান পেতে আমি শুধু শুনে চলি বাগ্দেবীর কড়া নাড়া!

বেহালা

বিকেলের ভাঁজপত্র খুলে
তুমি পেয়ে গেছো হারানো পুরাণ কথা
ঘোটকীর হ্রেষালিপি
আর ঘুমবেহালার ছড়—

কাহারবা বেজে ওঠে ধীরে ধীরে
শহরের শেষ রেখাপথে—

শোনো, ওটা ছিল এক ঝাড়বাতিঅলা বাঈজিমহল—
খিলানের ছায়াভ্রমে
আজও শোনা যায়
শ্বেতাভ কাকাতুয়ার সান্ধ্যগান—
ঝিনুকের অনুষ্টুপ
আর ভ্রমরের স্বরগ্রাম!

জানি, তুমি হারিয়ে ফেলেছো সব স্বর—
পাতার ডেরায় ডুব দিয়ে
তুমি শুনে যাচ্ছো শুধু জমে থাকা জলের লিরিক!

ডেরা

এই অরণ্যের সরুপথে
হারানো পায়ের ছাপ ধরে
হেঁটে যেতে যেতে
হঠাৎ পেলাম দেখা সেই নিঝুম ডেরার—
পাতার পোশাকে যার মাঝে বসে আছে
ডাগর চোখের এক বনদেবী!

ডেরার ভেতর ঢুকতেই
বনদেবী আমাকে দেখিয়ে দিলো
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা
নর্তকমূর্তির সারি সারি মুখ—
শ্বেতপায়রার রক্তাভ পালক
আর তিয়াসার ফেনাপাত্র!
পাতার কাঁচুলি খুলে
বনদেবী আমাকে বুঝিয়ে দিলো
টানটান বুকের ইশারা!

চকিতেই যেনবা আমার জেগে উঠল বোধ—
নির্বাণের আভা—
ডেরার ভেতর যেন জ্বলে উঠল
জমে থাকা লুকোনো প্রতিভা—
আদিম বনদেবীর কাছ থেকেই
যেনবা পেয়ে গেলাম
জগতের যত জ্ঞান—জ্যোতির্ময় রত্মবিভা! 

ছায়া ও ছাতিমতলা

এই দূর মফস্বলে আমাকে ডাকছে শুধু হুহু দোয়েল-দুপুর, বিকেলের ঘুঘুডাক, গোধূলির সান্ধ্যভাষ—বিলাপ ও নৈঃশব্দ্য!
একটি রঙিন রিক্শায় দেখি উড়ে বসে কয়েকটি চকমকি প্রজাপতি, ডাহুকীর ডানা চিরে বেজে ওঠে বিকেলের ধূলিরেখা, ভাঙা ডাকবাক্স আর কোটরের টিয়াগান!
ছায়া ও ছাতিমতলা পার হয়ে এই দূর মফস্বলে আমাকে ডাকছে শুধু চায়ের টংঘর, কচুরি ফুলের ডিঙিস্বর, হুইসেলে জংশনের সুর!

পানশালা

সব রাস্তা আজ বন্ধ, মধ্যরাতে, এই কুহক নগরে। রেস্তোরাঁর ঝাড়বাতিগুলো সব বন্ধ—লণ্ঠনের নীলাভ আলোয় দ্যাখো অদ্ভুত দেখাচ্ছে এই প্রত্নশহরটাকে! হরিণের ছালে ঢাকা শব্দাবলি নিয়ে আমি ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছি মধ্যরাতের পানশালায়। জানি ওখানে প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কতিপয় শব্দগ্রস্ত কবি!

আচমকা হাওয়ায় হারিয়ে যাওয়া একটি ভায়োলিন উড়ে এলো আমার হাতে, আমার পুরনো শব্দগুলো ঘুরপাক খেতে খেতে করোটির রেখাপথে সুর হয়ে বাজতে থাকল!

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর