বাংলা ভাষার আধুনিক কবি রফিক আজাদ। রোমান্টিক রবীন্দ্রোত্তর তিরিশি আধুনিকতার বিকাশ পরবর্তীকালে তার বেড়ে ওঠা। ফলে বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় আধুনিকতার চিন্তার যে ছায়া বাংলাভাষাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল—রফিক আজাদ তারই ধারাবাহিকতার অংশ। উত্তাল ষাটের দশকেই রফিক আজাদের চিন্তা আর কবিতার বিকাশ ঘটে। উদ্দাম, সহজ আর বোহেমিয়ান জীবনাচরণের জন্যও তিনি আলোচিত। তবে আধুনিক কবিতার যে বৈশিষ্ট্য—নাগরিক বিচ্ছিন্নতা, সমকালীন বাস্তবতা, সময়ের চাপ, রাজনৈতিক মনস্কতা, ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা সবই তার কবিতায় দৃশ্যমান। তার প্রথম ‘অসম্ভবের পায়ে’ কাব্যগ্রন্থ পরখ করলে এটা টের পাওয়া যায়। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে।
রফিক আজাদের কবিতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। একটি, রাজনৈতিক মনস্কতা আর অন্যটি নাগরিক বিচ্ছিন্নতা থেকে রোমান্টিকতার দিকে ধাবিত হওয়া। প্রথমত, সমকালীন রাজনৈতিক মনস্কতা তার কবিতাকে জাতীয়তাবাদের দিকে নিয়ে যায়। না হলে রফিক আজাদ কিভাবে লিখেন, ‘ভাত দে হারামজাদা, না হলে মানচিত্র খাব।’ ১৯৪৭ সালের ভারতভাগ ও তৎপরবর্তী পাকিস্তানের দুঃসহ-শাসনামলের বাস্তবতা তার রাজনৈতিক চিন্তার জন্ম দেয়। ফলে মানুষের মুক্তি তাঁর আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে। এই মুক্তি নিছক ব্যক্তির মুক্তি নয়। আপামর সমাজের মুক্তি। গণমানুষের মুক্তি। মুক্তিকে তিনি অধিকার রূপেই দেখতেন। ফলে কবিতায় তিনি ‘রাজনৈতিক বিদ্রোহী’ রূপে হাজির হন।
দ্বিতীয়ত, আধুনিকতার অবক্ষয় মানুষকে রাষ্ট্র, সমাজ বিচ্ছিন্ন করে তোলে। আধুনিক সমাজ ব্যক্তির যে নিরঙ্কুশ বিকাশের কথা বলে সেটা পরাহত হয়। এমনই পরাহত সমাজে কবি আশ্রয় চান, প্রেমিকার কাছে প্রেমের কাছে। ফলে রফিক আজাদ বলেন, ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,/ পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;/ ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,/ বিরহ-বালুতে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি;/ ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি/ খুব করে ঝুঁকে থাকা;/ ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি,/ বৃষ্টির একটানা ভিতরে-বাহিরে/ দু’জনের হেঁটে যাওয়া;/ ভালোবাসা মানে ঠান্ডা কফির/ পেয়াালা সামনে/ অবিরল কথা বলা;/ ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে—/ যাওয়া কথার পরেও/ মুখোমুখি বসে থাকা। [ভালোবাসার সংজ্ঞা : রফিক আজাদ]
কবি ‘ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া’—এমন সংজ্ঞা দাঁড় করালেন। এই ঝুঁকি শুদ্ধ প্রেম নয়, প্রেমের পরেরও অর্জন। আর ‘বিপ্লব’ আর ‘বিদ্রোহ’কে যত রোমান্টিকই আখ্যা দেই না কেন, শেষ নাগাদ সেটা ‘ঝুঁকি’ই। কারণ প্রেমকে তিনি রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে মেলাতেন। নাগরিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মানুষের যে মুক্তির বাসনা, কবিকে সেটা প্রেমের মতো আচ্ছন্ন করে রাখত। মুক্তিযুদ্ধ আর জাতীয় আকাঙ্ক্ষা তাঁর কাছেই ঝুঁকিরই নামান্তর। ফলে তিনি জাতীয় সংকটকালে থেকেছেন মিছিলের অগ্রভাগে। যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। যেই যুদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্রের। কবির সেই স্বপ্ন একাত্তরে সফলও হয়েছে।
জীবনের দীর্ঘ পথে কবি ভালোবাসা বিলিয়েছেন অকাতরে। তবে কতটুকু পেয়েছেন সেই প্রশ্ন আপেক্ষিক। কবির জন্য আমাদের অশেষ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।