ওবায়েদ আকাশের একগুচ্ছ কবিতা

কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

ওবায়েদ আকাশ | 2023-08-31 21:35:58

মেটামরফসিস : মনিরুজ্জামান

ছিপি খুলে ঘুমের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মনিরুজ্জামান

কারা যেন দীর্ঘ ঘুম মুড়ি দিয়ে পড়েছিল চিলেকোঠার খাটে
এবং প্রস্থান কালে ঘুমের মুখে ছিপি এঁটে
                        পেরিয়ে গেছে প্রমোদ সরণি

আমাদের মনিরুজ্জামান তাতে আটকা পড়ে
কতগুলো পুকুরের চারা এবং অরণ্যের ডিম
সফল প্রজনন হেতু ফেলে এসেছে; এবং পুকুরের গায়ে
জলপাই শ্যাওলার এক প্রকাণ্ড চাদর প্রান্ত ধরে টেনে
শরীরে মুড়িয়ে লোকালয়ে ফিরে এসেছে

আজকাল তার সন্তানের প্রতি সিংহের মতো স্নেহ এবং
স্ত্রীর প্রতি ইঁদুরের মতো নিষ্কণ্টক ভালোবাসা দেখে
কেউ কেউ তার নাম পাল্টে ফেরারি রেখেছে

গাঁগঞ্জের ফেরারি-মন মানুষেরা উঠতে-বসতে ঘুরতে-ফিরতে
সারাক্ষণ তাকে বন্দি করে রাখে
এবং ব্যক্তি মানুষেরা তার মতো আকস্মিক বদলে যেতে
কেউ বাঘের মতো কেউ ছারপোকার মতো অভিনয় করে
                                তার মনোযোগ খুঁজতে থাকে

শুধু মনে মনে ভাবে মনিরুজ্জামান:
এক জীবনে আর কতবার হারালে
একদিন শীতল বৃষ্টির মতো আকাশের করুণা কুড়নো যাবে!

ওয়াহিদউদ্দিন তালুকদার : আমার শিক্ষক

আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ওয়াহিদউদ্দিন তালুকদার

এইভাবে বিশুদ্ধ নামে কখনো ডাকতে পারিনি আগে—
এখন মার্কিন মুল্লুকে থাকেন
ছেলের হাতে পাকানো রশিতে ক্রমাগত পাটের সোনালি আঁশ
যোগান দিতে দিতে এখন নিজেই তাতে বঙ্কিম হয়ে আছেন

একদিন ঘোর দুর্যোগের কালে গভীরতর ঘুমে
তাকে স্বপ্নে দেখেছিলাম—
তিনি আমাদের স্কুলের বারান্দা দিয়ে অফ হোয়াইট পাঞ্জাবির শাসন
এবং পুরু ফ্রেমের হুঙ্কার পরে হেঁটে যাচ্ছেন, আর ওদিকে
হোয়াইট হাউসের সর্বোচ্চ দাম্ভিক ইটগুলো এক এক করে
খসে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে—

এরপর প্রতিটি ক্লাস সেলাই করে করে আঙুল তো নয়, এবার
মুখভর্তি হাসি উঁচিয়ে বলছেন, আজ আর তোমাদের ক্লাস নিতে আসিনি
ওই যে আকাশে উড়ছে পাখি, স্বপ্নের কত যে রঙ
কোনোটা ধূসর কোনোটা সরল আত্মবিশ্বাসী, যাও
আজকে সবাই পাখি ধরে আনো—
আর হৈ হৈ করে আমরা সবাই ক্লাস ভেঙে আকাশে উড়তে থাকলাম
আর যত খুশি পাখি ধরে ধরে, আবার নক্ষত্রের দিকে হাত বাড়ালাম

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ঘামতে ঘামতে মনে পড়ে গেল, একদা তিনি
ক্লাসভর্তি শিক্ষার্থীকে বলতেন, “মনে রেখো কিন্তু, নয় উপাসনালয়—
সর্বাধিক পবিত্র জেনো তোমার বিদ্যালয়।”
তবে কি আমার শিক্ষক আজ বিদ্যালয় ছেড়ে আমাদেরকে
উপাসনালয়ের দিকে হেঁটে যেতে দেখেন?
অন্যথা কেন সেই মার্কিন মুল্লুক থেকে উড়ে উড়ে
এই পাড়াগাঁয়ের অনামি শিক্ষার্থীর স্বপ্নে ঢুকে গেলেন?

ভাবতে ভাবতে এটাও প্রতিধ্বনিত হলো—
তিনিই তো বলতেন কতবার—“হেথা নয় হোথা নয়, জেনো
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সি”

নন্দিনী : শরীরীকলায়

কলাবিদ্যায় ঝুলে আছে নন্দিনীর কাটা স্তনের পাশে
বাইজানটাইন সভ্যতার ঘুমন্ত ফড়িং

নন্দিনীর শরীরীকলায় ধৃষ্টতার দাঁতগুলো
সাদাকালোয় রাঙিয়ে দিয়েছে ক্ষণিক পৃথিবী
মথ এসে খেয়ে গেছে প্রাতঃকিরণের রক্তলালপ্রীতি

নন্দিনী তার শরীর ছেকে টেনে টেনে
লোকালয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে সভ্যতার ভেজা বস্ত্রগুলি

তা থেকে ফিনকি দিয়ে ছুটে আসছে কারোবা মাথা
কারো হাত পায়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ নাভি

নন্দিনীর কাটা মস্তকের ঢালে আজ আবার মেঘ করে
শীত ঋতু ভিজিয়ে দিতে ঝুঁকে এসেছিল বর্ষণের দ্বিধা

হস্তরেখা ফাঁকি দিয়ে গুণী-ঋষি জেনেছিল
কলাবিদ্যা ভেসে যাবে এমন প্লাবন যদি দীর্ঘায়িত হয়

কবন্ধ শরীর ফুঁড়ে আবার নন্দিনী উঠে
                      অবিকল ডুবে গেছে শরীরীকলায়

পঞ্চানন ঘোষ : ঘোল বিক্রেতা

ভোর হতে না হতেই কুমার নদের কম্পমান সাঁকো পাড়ি দিয়ে
পঞ্চানন ঘোষ ঘোল নিয়ে আসেন—‘ঘোল, হেই ঘোল’ বলে—
কিংবা আমিই ছুটে যাই দুরু দুরু বুকে বাঁশের সাঁকো হেঁটে

আমি যখন গ্লাস ভরে ঘোল দিতে বলি, ভেসে ওঠা ছানার দিকে
চলে যায় চোখ, আর পঞ্চানন যখন একবার আমার দিকে একবার
ঘোলের দিকে তাকিয়ে ঘোল দিতে যায়
ঘোলের পাত্রের নিচে অথৈ জলের বন্যা বয়ে যায়...

আমি তাকে বলি, ‘এত জল কোথা থেকে আসে?’
পঞ্চানন বলে, ‘ছোট্টবেলায় সাঁতার কাটতাম আরো গভীর জলে’

আমি পঞ্চাননের মুখের দিকে বিস্ময়ভরে তাকাতেই
তার চোখের মণিতে দু’তিনজন শিশুসন্তানের মুখ
ভেসে উঠতে দেখি। দেখি তারা সাঁতার কাটছে
আরো অথৈ জলে

আমি পঞ্চাননকে বলি, ‘তোমার পাত্র থেকে জল ছেকে
আরেক গ্লাস ঘোল দাও তো দেখি’
পঞ্চানন ঘোলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে আমার দিকে
জলবিহীন ঘোল তুলে দেয়
আমি কী মজা কী মজা বলে চুকচুক করে ঘোল চেটে খাই আর

পঞ্চাননের চোখ থেকে শিশুগুলো
ঝুরঝুর করে মাটিতে পড়ে যায়

নির্মলদা বিষয়ক স্বকীয়া

প্রতিবেশি নির্মলদা ভূয়োদর্শী ছিলেন
এখন বাড়িতে আছেন এবং
বাজার থেকে ব্যক্তিগত দেহখানা
কসাইখানা দর্জিখানায় সারিয়ে নিয়ে
পুনর্বার বেরুবেন বলে ভাবছেন

ব্যক্তিগত বলতে নির্মলদার স্ফিত ভুঁড়ি
চকচকে ত্বক এবং দীর্ঘশ্বাসের চওড়া উঠোন ব্যতীত
অন্য যা যা ছিল, এখন তাতে শপিং সরণি
দাতব্য শুশ্রুষালয় কিংবা প্রপঞ্চ ম্যাসাজ পার্লার
বেশ মানিয়ে উঠেছে—

নির্মলদা যখন একটি প্রাচীন চিঠির ভেতর থেকে
লাফিয়ে পড়ে সারা গাঁয়ের মুঠি মুঠে সমর্থন কুড়িয়ে নিলেন
তাকে তিনি ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বলে টাঙিয়ে নিয়ে
একপ্রকার আত্মপ্রচারের ঝুঁকি নিয়েছিলেন

আজকাল তার সমূহ প্রচারণাজুড়ে
দুর্ভিক্ষের চাঁদ, রোদওঠা কুকুর ও স্বাস্থ্যবতী প্রপাগান্ডাগুলো
দাপিয়ে বেড়ায়

নির্মলদা এখনো বাড়িতে আছেন—
হাঁটেন ফেরেন, বমি করেন— নিশ্চিন্ত শুশ্রুষায়

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর