১০৮তম জন্মদিন পেরিয়ে এসেছেন তিনি সদ্য। কাশ্মীর ছিল তার পূর্বপুরুষের ভূমি। কিন্তু তিনি জন্মেছিলেন অবিভক্ত পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় ১৯১২ সালের ১১ মে, যা এখন ভারতের অংশ এবং কৃষি ও দুগ্ধ পণ্যের জন্য বিখ্যাত।
মারাও যান তিনি সেই পাঞ্জাবেরই পশ্চিম অংশের বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে, ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের জন্য উন্মূল হয়ে আসা লাহোরকে তিনি বলতেন দ্বিতীয় ভূমি।
দেশান্তরের বিরূপ ভাগ্য বরণকারী লোকটির নাম সাদত হাসান মান্টো। ভারত, পাকিস্তান মিলিয়ে তাবৎ দক্ষিণ এশিয়ার উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার তিনি। তাকে গণ্য করা হয় আধুনিক উর্দু সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা হিসেবে। ডাকা হয় তাকে 'দেশভাগের কথাকার' নামেও।
দাঙ্গা, হাঙ্গামা, রাজনৈতিক পালাবদল, দেশান্তর, জীবনসঙ্কট মিলিয়ে ঘোরতর সঙ্কুল পরিস্থিতি সামলিয়ে তিনি বেঁচেছেন মাত্র ৪৩ বছর। তারই মধ্যে রচনা করেছেন ২২টি ছোটগল্পের সংকলন, ১টা উপন্যাস, রেডিও নাটকের ৭টা সংগ্রহ, ৩টা প্রবন্ধ সংকলন, ২টা চেনা মানুষদের স্মৃতিকথা, বহু আলোচনা ও টক, অনেকগুলো সিনেমার চিত্রনাট্য, যার মধ্যে অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র 'মির্জা গালিব' অন্যতম।
গালিবের মতোই ছিল তার পীড়িত জীবন আর দুর্ভাগ্যের নিয়তি। গালিব ও মান্টো উভয়েই দেখেছেন রাজনৈতিক হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস-কবলিত, রক্ত-প্লাবিত ভারত। গালিবের সামনে দিয়ে সন্ত্রাসের রক্তাক্ত পথে মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙে কায়েম হয়েছিল ব্রিটিশরাজ।
আর মান্টোর চোখের সামনে দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে সাম্প্রদায়িক রক্তাক্ত হানাহানির পথে বিভক্ত উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান নামের দু'টি রাষ্ট্র। তিনি নিজেও যে বিভাজনের ফলে গৃহহারা উদ্বাস্তু হয়েছিলেন।
মান্টো জীবনের বাস্তবতায় যা দেখেছেন, তাকেই কথাশিল্পে উপস্থাপিত করেছেন: 'পুরোদমে লুটতরাজ চলেছে। তারপরে যখন আগুন ধরিয়ে দেয়া হলে লাগলো সব বিষম গরম হয়ে উঠলো। একটা লোক কাঁধে একটা হারমোনিয়াম চাপিয়ে পরমানন্দে গান গাইতে গাইতে ছুটলো, যব তুম হি গয়ে পরদেশ লাগকর তাইশ, ও প্রীতম পিয়ারে, দুনিয়া মেঁ কৌন হামারা?'
'কালো সীমানা' গল্পে মান্টো যে গানটি উদ্ধৃত করেছেন, তার বাংলা অর্থ হলো: 'হায় আমার প্রীতির পিয়ারী, যখন তুমিও আমাকে ছেড়ে দূরদেশে চলে গেলে, তখন দুনিয়ায় আমার আর কে রইলো, বলো?'
এমনই আরো অনেক কাহিনী রচনা করেছেন তিনি উপমহাদেশের ভাগাভাগির প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে। বেদনার স্রোতে ভেসে আসা রক্ত হিম করা মান্টোর গল্পগুলোতে দেশভাগের এমনই মানবিক আখ্যান ধরা পড়েছে, যা লিপিবদ্ধ করেনি রাজনৈতিক ভাষ্যকারগণ। 'টিথওয়ালের কুকুর', 'শেষ স্যালুট', 'খুলে দাও', 'টোবা টেক সিং', 'শরিফান', 'সহায়', 'ঠাণ্ডা গোস্ত' ইত্যাদি গল্পে মান্টো ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের চরমতম প্রকাশকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ কেবল উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব অংশকে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ভাবে বিভাজিত করেনি, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক দিক থেকেও চরমভাবে বিপর্যস্ত ও রক্তাক্ত করেছিল। বিশেষত, পশ্চিম প্রান্তে হিন্দু, মুসলিম ও শিখ সম্প্রদায় রাজনৈতিক উন্মাদনায় পরস্পরের রক্তে হোলিখেলায় মেতেছিল। দেশভাগের ফলে লক্ষ মানুষের মৃত্যু ও বাস্তুচ্যুতির কথা রাজনৈতিক ইতিহাসে সবটুকু উপস্থাপন না হলেও সাহিত্যের পাতায় তা রয়ে গেছে।
উর্দু সাহিত্যে মান্টো এবং আরো অনেকেই, যেমন খুশবন্ত সিং, অমৃতা প্রীতম, কৃষণ চন্দর, খাজা আহমদ আব্বাস, ইসমৎ চুগতাই, কুদরৎ উল্লাহ সাহাব, রাজিন্দর সিং বেদি প্রমুখ দেশভাগের পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক নখরে ক্ষত-বিক্ষত মানুষ ও মানবতার কথাকার হয়ে পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা।
বিশেষত সাদত হাসান মান্টো এই তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছেন নিজের কমিটমেন্ট, সম্পৃক্ততা, সাবলীলতা ও সাহসিকতার জন্য। নিজে অভিজাত ও সম্পন্ন পরিবারের সন্তান হয়েও দেশভাগের কারণে হারিয়েছেন নিজের দেশ ও সবকিছু। ফলে সেই ক্ষতকে তিনি ভুলতে পারেননি। কলম আর কাগজকে সঙ্গী করে লিখেছেন সেই নির্মম অভিজ্ঞতা।
দেশভাগ ও দেশান্তরের ফলে অনেকের ভাগ্যোন্নয়ন হলেও ভারত থেকে পাকিস্তান এসে মান্টোর অবস্থা আরো খারাপ হয়। ততদিনে তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়ে যায়। যে কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রেও তার দিন সুখের ও নিরাপদের হয়নি। নিজের দেশ হারিয়ে নতুন দেশে এসেও তাকে আপন দেশ করতে পারেননি তিনি। বিরূপতার মধ্যেই অবসান হয় তার সংগ্রামশীল জীবনের।
তবুও থেকে যায় মান্টোর কালজয়ী কথাসাহিত্য, যেখানে তিনি যেন তার গল্পের নায়কের মতোই এক দেশহীন নাগরিক:
'সূর্য ওঠবার কিছুক্ষণ আগে, তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বিষণ সিং-এর গলা চিরে একটা তীব্র বিলাপ বেরিয়ে এলো। কর্মচারীরা, কর্তারা, সবাই ছুটে এলো উর্ধ্বশ্বাসে। দেখতে পেলো, যে লোকটা গত পনেরো বছর দিনরাত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কাটিয়েছে, সে পড়ে আছে জমির ওপর, উপুড় হয়ে। তার পেছনে কাঁটাতারের বেড়া, সেদিকে ভারতবর্ষ। সামনে ঐরকমই আরেকটা কাঁটাতারের বেড়া, তার ওপাশে পাকিস্তান। মাঝখানে, যে জায়গাটা কোনো দেশেরই নয়, সেখানে পড়ে আছে বিষণ সিং বা টোবা টেক সিং-এর মৃতদেহ।' [ গল্প: টোবা টেক সিং, সাদত হাসান মান্টো, অনুবাদ: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।]
সাদত হাসান মান্টোও যেন নোম্যান্সল্যান্ডের বাসিন্দা, তবু ভারত, পাকিস্তান, সবার; পুরো দক্ষিণ এশিয়ার এবং সমগ্র পৃথিবীর মানবিক সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।