ক’দিন শরীরটা খারাপ ছিল, আজ সকাল থেকে খানিকটা আরাম বোধ করতে শুরু করেছিলাম কিন্তু বৈশাখের এই বিকেলবেলাটাতে মনের সমস্তটা আকাশ মেঘে ছেয়ে দিল। আমাদের অসংখ্য মানুষের শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। তিনি আমার শিক্ষক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারের শিক্ষক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষক এবং আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বেরও তিনি ছিলেন শিক্ষাগুরু।
আমি স্নাতক সম্মান উত্তীর্ণ হই চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে, স্নাতকোত্তর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্যার আমাদের পড়াতেন বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথের কালান্তর। গবেষণা-পত্র নেওয়ার সুবাদে কোনো-কোনো ক্লাস আমার না করলেও চলত কিন্তু স্যারের ক্লাস আমি করতামই। একদিন স্যার করিডোরে হাঁটতে-হাঁটতে বলেন, আমার ক্লাস তোমার তো না করলেও চলে। আমি বললাম, করলে আমার ভালো লাগে, তাই করি। স্যার মৃদু হাসেন। আমি এম এ ক্লাসে হাসান আজিজুল হক নিয়ে কাজ করছিলাম। একদিন আমাকে ডেকে স্যার জিজ্ঞ্যেস করেন, তুমি কি তাঁর কথাসাহিত্যের কথকতা বইটি পড়েছো? বললাম, পড়েছি। বেশ কৌতূহলী দৃষ্টিতে স্যার পাল্টা প্রশ্ন করেন, বইটা ঢাকায় বেরিয়েছে সপ্তাহখানেক হলো, পেলে কোথায়? বললাম, বইটি ঢাকার জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে। ঘটনাচক্রেই আমি সেটি ম্যারিয়েটা থেকে সংগ্রহ করি। স্যার আমার গবেষণাকর্মের খোঁজখবর নেন। সম্ভবত আমরাই ছিলাম তাঁর শেষ ছাত্রগোষ্ঠী। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান (সেখানে তাঁর দ্বিতীয় পর্ব।)।
স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্যারের সঙ্গে তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারের বাসভবনে দেখা করতে যাই। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান, আমি আঁচ করেছিলাম, তুমি প্রথম শ্রেণি পেতে পারো। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তিনি ছিলেন বহিস্থ পরীক্ষক—ঐ পত্রে আমি পেয়েছিলাম ৬৮ নম্বর। তখন গ্রেডিং পদ্ধতি ছিল না। স্যারের সঙ্গে পেশাগত প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করি। তিনি একটা পরামর্শ দেন আমাকে—মনে রাখবে তোমার লেখাপড়ার আরম্ভ হলো এখন। আসলেই তাই। এর কিছুদিন পর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যারেরই অধীনে গবেষণা-বৃত্তি পাই এম ফিল-এ। আমার গবেষণার বিষয় ছিল বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে সমকালীন ঘটনার প্রতিফলন। ঐ সময়টাতেই একই সঙ্গে প্রফেসর সৈয়দ আকরম হোসেন স্যারের অধীনে বৃত্তি পান গিয়াস শামীম যিনি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হ’ন এবং এখন সেখানে কর্মরত। আমি আর কাজটা করতে পারি না। যে-মুহূর্তে কাজ শুরু করব তখনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগদান-পত্র পাই। বাবা বললেন, তুমি ঢাকায় গিয়ে তোমার স্যারের সঙ্গে দেখা করো, স্যার কি বলেন দেখো। গেলাম স্যারের বাসায়।
যাচ্ছিলাম ট্রেনে, সম্ভবত সমতা এক্সপ্রেসে। পথে যেতে-যেতে ভাবছিলাম অনেক কথা। আমার বাবার নিজের জীবনে পেশাগত পর্ব শুরুর প্রাক্কালে দু’টো বিবেচনা কাজ করে। তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন। সেটা আর হয় না। দ্বিতীয়টাই সফল হলো—সরকারি চাকুরিতে যোগদান করলেন। দেখা হতেই স্যার অভিনন্দন জানালেন চাকুরি প্রাপ্তির সাফল্যের জন্যে। যেহেতু গবেষণাকর্মটির শর্ত ছিল সার্বক্ষণিক তাই আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরিটিকেই বেছে নিই। কিন্তু স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ কখনো ছিন্ন হয় না।
ছাত্রাবস্থাতেই স্যারকে নিয়ে আমি একটি প্রবন্ধ রচনা করি। তাঁর গ্রন্থ পুরোনো বাংলা গদ্য সম্পর্কিত সে-প্রবন্ধ ছাপা হয় কবি অমিত চেীধুরী সম্পাদিত মূল্যায়ন পত্রিকায়। একদিন বিভাগে দেখা হতেই বললেন, তোমার লেখাটা পড়েছি, ভালো লেগেছে। পরবর্তীকালে আরো ৫/৬টি প্রবন্ধ লিখেছি তাঁর কর্ম বিষয়ে এবং সেগুলো আমার বিভিন্ন গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে। আমি এবং আমার শিক্ষক ও সহকর্মী প্রফেসর ড. সৌরেন বিশ্বাস এবং আমার পিএইচডি-ছাত্র মালিক সোবহান আনিস স্যারের জীবন ও কর্ম বিষয়ে একখানা গ্রন্থ প্রকাশ করি—আনিসুজ্জামান : বাঙালি মনীষার প্রতিকৃতি শিরোনামে। ভাবতে ভালো লাগে এ-গ্রন্থ তাঁর জীবন ও কর্ম বিষয়ক সর্বপ্রাথমিক গ্রন্থও বটে। আমার এম এ গবেষণা-অভিসন্দর্ভ গ্রন্থাকারে ছাপা হলে স্যার সেটির ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন সস্নেহে।
১৯৯১ সালে আমাকে কয়েক বছরের জন্যে ইংল্যান্ডে যেতে হয়। যাওয়ার আগে স্যারের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে ব্রিটিশ মিউজিয়ম এবং ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে কাজ করবার পরামর্শ দেন। একবার স্যার সংক্ষিপ্ত সফরে লন্ডন গেলে সেখান থেকে আমাকে ফোন করেন। বললেন, তুমি আর মিতু (আমার স্ত্রী) চলে এসো, আমরা একবেলা একসঙ্গে খাব। বলাবাহুল্য কেম্ব্রিজ থেকে লন্ডন যাই স্যারের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে। আনিস স্যারের ছাত্র-ছাত্রী অসংখ্য। কিন্তু তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। প্রায় সকলকেই চিনতে পারতেন এবং প্রচুর সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর নাম তাঁর মনে থাকত।
একটু আগে আমার যে-ছাত্রটির কথা বললাম মালিক সোবহান, সে আমারই গবেষণা-নির্দেশনায় আনিসুজ্জামানের জীবন ও কর্ম বিষয়ে পিএইচডি কোর্সের কাজ শুরু করে। স্যারের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে মালিক ঢাকা গেলে স্যার জিজ্ঞ্যেস করেন, তোমার সুপারভাইজার কে? মালিক আমার নাম বললে স্যার সস্নেহে মালিককে বলেছিলেন, তুমি যখনই খুশি আমার বাসায় লাইব্রেরিতে এসে কাজ করো। দুর্ভাগ্য, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ জমা দেওয়ার মাসখানেক আগে মালিক সোবহান স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করে। তবে, তার সেই গবেষণাকর্মটি পরে কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমির কর্মকর্তা সাংবাদিক নুরুল ইসলাম গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন এবং মালিক সোবহানের এ-গ্রন্থ আনিসুজ্জামানের জীবন ও কর্ম সম্পর্কিত প্রথম গ্রন্থও বটে। স্যার খুব দুঃখ পেয়েছিলেন মালিকের মৃত্যুতে কিন্তু তার গ্রন্থটি স্যারকে খুব আনন্দ দিয়েছিল।
স্যারের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে অনেক লেখা যায়। সেটা এই ক্ষুদ্র প্রতিক্রিয়ায় সম্ভব নয়। এত বিপুল তাঁর কর্মপরিধি যে তা অল্প কথায় লিখে শেষ করা যাবে না। যে-কোনো মানুষকে গুরুত্ব দেওয়ার শিক্ষা স্যারের কাছ থেকে পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রথম আলোর পরিকল্পিত সংখ্যায় লেখা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে স্যার আমাকে ফোন করেন। আমি জবাবে বলি, অনুরোধ কেন স্যার আপনি তো আমাকে আদেশ করবেন। ২০০৪ সালে আমার বাবা মৃত্যুবরণ করলে তিনি ঢাকা থেকে ফোনে আমাকে শোক ও সমবেদনা জানান। বাবাকে স্যার চিনতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকেই। বাবা ১৯৫৪ সালে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন, পরে আবার আইন বিষয়েও উচ্চতর ডিগ্রি নেন। তিনি ছিলেন আনিস স্যারের দুই বছরের সিনিয়র।
আজ এই করোনাক্রান্ত দিনে আমরা এতটাই অসহায় যে আমাদের শোক প্রকাশ করবার প্রকাশ্য অবস্থাও আমাদের সক্ষমতার মধ্যে নেই। অল্প ক’দিনের মধ্যে তিনজন জাতীয় অধ্যাপককে হারালাম আমরা।
তাঁর লেখা পড়েছি, পড়বো সামনের দিনেও কিন্তু তাঁকে আর দেখতে পাবো না সেই বেদনাটাই সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে।