সানোয়ার রাসেলের একগুচ্ছ কবিতা

কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

সানোয়ার রাসেল | 2023-09-01 13:58:06

দুয়া কুনুত

সালাতুল বিতর পড়তে গিয়ে
আচানক তোমার কথা মনে পড়ে যায়।
কনে দেখা সাজ,
ভরা মজলিশ,
হাসি-হুল্লোর,
মিষ্টি-মেঠাই,
ময়-মুরুব্বি,
ভরা মজলিশ।
আসরের এক প্রান্তে ঘোমটাসমেত তুমি,
অন্য প্রান্তে আমি।
হঠাৎ তোমার প্রতি প্রশ্ন নাজেল হলো,
‘দুয়া কুনুত পারো? শোনাও তো একটু।’
অপ্রস্তুতের মতো তুমি নিচু কণ্ঠে শুরু করলে,
‘আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্তাঈনুকা, ওয়া নাস্তাগফিরুকা, ওয়ানু মিনুবিকা...’
ভরা-মজলিশ,
ময়-মুরুব্বি,
তুমি ঘাবড়ে গেলে,
ওয়ানু মিনুবিকার পর দুয়া কুনুত আর এগুলো না।
ওদিকে তোমার কান্না চাপার প্রয়াস আর
আরক্তিম গণ্ডদেশ দেখতে দেখতে
আমি শেরোয়ানি পরা গর্দভের মতো
অক্ষম ক্রোধে ঘামতে লাগলাম।

এখনো ঘামি,
সালাতুল বিতরের মাঝে।
দুয়া কুনুতে আটকে গিয়ে ভাবতে থাকি
প্রশ্নটা সেদিন যদি আমাকে করা হতো?
এইসব ভেবে ভেবে
আমার সারাদিনের ইবাদত
সপ্ত-আসমানে ঘুরপাক খেতে থাকে।

ফজর

রাতের চরণ শেষ,
নিশাচর প্রাণিরা গেছে এবার বিশ্রামে।
পুবের আকাশে এক অদ্ভুত আলো আসে নেমে!
সুবহে সাদেক! সুবহে সাদেক!
এই আলো দেখবে না জগতের লোকে?
দেখবে না, রাত্রির ঘুম বাসা বেঁধে আছে
যাহাদের চোখে।
এমন সময়,
যেন এক সুবাতাসে বয়ে আসে
আজানের সেই শুভ ধ্বনি—
‘আস সালাতু খায়রুম মিনান নাওম’
ক্লেদের বিছানা ছেড়ে মানুষেরা উঠবে এখনি।
পশ্চাতে পড়ে রবে ব্যয়িত অতীত আর
মরে যাওয়া রাত,
সুবহে সাদিক নিয়ে এলো এক নয়া সওগাত,
নতুন প্রশ্বাসে।
শীতল বাতাসে সব ক্লান্তি উবে যায়।
সুবহে সাদিকে যারা দেখে সেই অপূর্ব আলো,
মহান রবের নামে রয় তারা নিমগ্ন সেজদায়,
অটল বিশ্বাসে!

সিনেমা

খাড়ু থেকে যাক ছিটকে ছিন্ন ঘুঙুর,
টুকরো কাচে ক্ষতাক্ত হোক পা,
নায়ক কাঁদবে অক্ষম চিৎকারে,
নায়িকা, তবু নৃত্য থামবে না।

খাড়ু থেকে যাক ছিটকে ছিন্ন ঘুঙুর।

নায়িকা নাচো, আমরা তাকিয়ে আছি,
তোমার হাতেই অনেকগুলো প্রাণ।
ভীষণ ভিলেন অশ্লীল চোখে চেয়ে,
দর্শক আর ডিরেক্টরেও এরকমটাই চান।

নায়িকা নাচো আমরা তাকিয়ে আছি।

নায়িকা তোমার চোখে কান্নার জল,
দস্যু ছিঁড়েছে আব্রুর অঞ্চল,
তোমার মা-বাপ খাম্বার সাথে বাঁধা,
তবু
নাচের মুদ্রা নির্ভুল, চঞ্চল!

নায়িকা তোমার চোখে কান্নার জল!

নায়িকা তোমার নৃত্য যেন না থামে,
তোমার পায়েই আমাদের নিশ্বাস।
আমরা দেখছি সকল মিথ্যে মেনে,
তোমার দুঃখে রাখিয়াছি বিশ্বাস।

নায়িকা তোমার নৃত্য যেন না থামে।

খাঁড়ু থেকে যাক ছিটকে ছিন্ন ঘুঙুর,
ঘামের মতোই টুপ করে ঝরে শাড়ি,
নায়িকা থেমো না, আসবেই ক্লাইমেক্স,
আমরা ভিউয়ার্স, মিথ্যে সইতে পারি।

খাঁড়ু থেকে যাক ছিটকে ছিন্ন ঘুঙুর।

বিজয়ের বহুদিন পরে আমি বিজয় খুঁজেছি

জালে যে জড়াতে পারে জলও,
তোমরা শিশির তাকে বলো।
আমি তাকে বলি দীর্ঘশ্বাস, একরাশ,
হতে চেয়ে হতে না পারার।
জীবনের দিকে চেয়ে মৃত্যুকে জড়িয়েছি আমি বারবার।

তারপর কোনো এক বিজয়ের দিনে,
বিজয়ের বহুদিন পরে, পথ চিনে
অলস পায়ের পরে ভর করে করে হেঁটে গেছি
তোমাদের ঘরহীন ঘরে, পথের কিনারে।
সেখানে সূর্য হয়ে জ্বলে পাতাগুলো,
কুড়ানো কাগজ, কাঠ তাপের আদরে ধুয়ে ধুলো।
বিজয়ের বহুদিন পরে,
বিজয় খুঁজেছি আমি তোমাদের ঘরহীন ঘরে।

পাইনি তা,
যায় না পাওয়া খোঁজ।
তোমাদের পেটের ভিতরে এক অনন্ত আকাশে
কতিপয় নক্ষত্র জ্বলে রোজ।

জীবনানন্দের ধূতি

জীবনানন্দ
আপনি সচরাচর ধূতি পরতেন
নাকি লুঙ্গি পরতেন
হঠাৎ এই প্রশ্ন মনে উদিত হলে
মনের পৃষ্ঠা উলটে পালটে দেখলাম
এর উত্তর আমি জানি না।

কারণ আপনার কোনো বইয়ের প্রচ্ছদে
আপনার বুকের নিচের অংশের ছবি নেই।
সেই সব আবক্ষ ছবিতে আপনি বিভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে
অপলক তাকিয়ে আছেন যুগের পর যুগ!
সেই চোখের দিকে তাকিয়ে আমি অন্তত
আপনার ধূতি কিংবা লুঙ্গি বিষয়ক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।

আপনি এত কিছু লিখলেন,
বনলতা, ক্যাম্প, মাঠের ইঁদুর, চালতার ফুল,
ঘাই হরিণী আরও কত সব!
তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, নাহ,
আপনি আপনার ধূতি বা লুঙ্গি বিষয়ে কিছুই লিখেননি।
এক কলমও না!
এমনকি আব্দুল মান্নান সৈয়দও এ বিষয়ে আশ্চর্য নীরব,
শম্ভূগঞ্জের বন্ধ হয়ে যাওয়া জুট মিলের মতন!

আপনি যখন ট্রামে কাটা পড়ে মারা যান,
জীবনানন্দ,
তখন আপনি কী পরে ছিলেন?
ধূতি, প্যান্ট নাকি লুঙ্গি?
কেউ কি বিষয়টা খেয়াল করেছিল?
নাকি সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল
বন্ধ হয়ে যাওয়া একজোড়া বিভ্রান্ত চোখের
গৃহী গৃহী চেহারার কবির চির ঘুমন্ত মুখের দিকে?

এ সম্পর্কিত আরও খবর