দেশভাগের পরপরই পূর্ব বাংলার মানুষ বুঝতে পেরেছিল; স্বপ্নের স্বশাসন এখনো বহুদূর। ফলে শুরু হয় নতুন তৎপরতা। পঁচিশ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় লক্ষ্য। যে মানুষটা গোটা অভিযাত্রা জুড়ে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন; তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানিরা কবর খুঁড়ে রাখলেও হত্যা করার দুঃসাহস দেখায়নি। সেই বর্বরোচিত কাজটা করেছে বাংলার মাটি জলে বেড়ে ওঠা মানুষেরাই। যার হাতে ধরে একটা দেশের জন্ম; সে দেশে তারই বেঁচে থাকা হয়ে উঠল না।
জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় সেনাবাহিনীর দুইটি শাখা। ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার এবং টু ফিল্ড আর্টিলারি। মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের অধীনে টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ৬ মাস আগে অব্দি ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সারও ৪৬ ব্রিগেডের অধীনে ছিল। কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মুমিন ছুটিতে থাকার কারণে ১৫ আগস্ট সি.ও ছিল টু আইসি মেজর ফারুক।
ঘটনার সময় ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের টু-আইসি ছিলেন ব্রিগেডিয়ার একেএম শাহজাহান। অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। আগস্টের ১৪ তারিখ রেজিমেন্টের অ্যামবুশ ডেমোনেস্ট্রেশন। সাফায়াত জামিল, জেনারেল জিয়া এবং খালেদ মোশাররফ সেখানে হাজির ছিলেন। অ্যামবুশ ডেমোনেস্ট্রেশন শেষ হয় বেলা ১১টার দিকে। হঠাৎ শাহজাহানের কাছে এসে দাঁড়ায় মেজর রশিদ। তার ট্রুপস্ নিয়ে রাতে নিউ এয়ারপোর্ট যেতে বলে। রাতে ট্রুপসের মার্চ করার অনুমতি না থাকায় রাজি হননি শাহজাহান। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র না রশিদ। নাছোরবান্দার মতো জোরাজোরি করতে থাকলে বাধ্য হয়ে উর্ধ্বতন সাফায়াত জামিল এবং খালেদ মোশাররফকে বলে দেন তিনি। তারা দুজনেই নিষেধ করে দেন।
একদিকে সাফায়াত জামিলরা গাজীপুর থেকে অ্যামবুশ ডেমোনেস্ট্রেশন শেষ করে ফোর্স ফিরেছে কি না তদারকি করছে; অন্যদিকে নাইট প্যারেডের অজুহাতে বেঙ্গল ল্যান্সার ফারুক এবং আর্টিলারি ইউনিটের রশিদ প্রস্তুতি নিচ্ছে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের। অস্ত্রাগার খুলে দেওয়া হয়েছে, মেজর ফারুক রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছে, ক্যান্টনমেন্টে চাকরিচ্যুতরা ঘোরাফেরা করছে; অথচ গোয়েন্দাদের চোখ কিংবা মনোযোগ কোনোটাতেই তা সন্দেহের উদ্রেক করেনি। আসলেই গোয়েন্দাদের চোখে পড়েনি; নাকি জেনেও না জানার অভিনয় ছিল?
প্রকাশ্য ব্রিফিংয়ে মেজর ফারুক ঘোষণা দেন সমবেত বাহিনীর উদ্দেশ্যে। “১৫ই আগস্ট ইউনিভার্সিটিতে মিটিং হবে। রাজতন্ত্র ঘোষিত হবে তখন। শেখ মুজিব রাজতন্ত্র ঘোষণা দেবেন। আমরা রাজতন্ত্র সমর্থন করি না। এখন আমি যা বলব, আমার অফিসাররা যা বলবে; তোমরা তা শুনবে। জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করলাম। সরকার আমাদের রক্ষা করতে পারছে না। জনগণ না খেয়ে মরছে। এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে।” তাছাড়া মোটাদাগে নিম্নরূপ চিত্র পাওয়া যায়।
১. নাইট প্যারেডের নামে ফারুকের ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার সদস্যরা রাতে নিউ এয়ারপোর্টে এক হয়।
২. তাদের সঙ্গে পরে যোগ দেয় রশিদের টু ফিল্ড আর্টিলারি।
৩. সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারাও নাইট প্যারেডে যোগ দেয়।
৪. রশিদ এবং ফারুক সেনা সদস্যদের সামনে সরকার উৎখাতের আহবান জানিয়ে বক্তৃতা দেয়।
৫. ট্যাংকের গোলা বা ছোট অস্ত্রের গুলিও ছিল না। কারণ মহড়ায় লাইভ অ্যামুনিশন থাকে না।
৬. রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে কর্নেল রশিদ এবং অন্যরা অস্ত্রাগার খুলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যায়।
৭. বালুরঘাট নিউ এয়ারপোর্ট থেকে খুনিরা বঙ্গবন্ধু ভবন, সেরনিয়াবাতের বাসা, রেডিও সেন্টার এবং শেখ মণির বাড়িতে পৌঁছায়।
৮. সারারাত ধরে চলে খুনের প্রস্তুতি।
৯. খুনিদের প্রথম দলটি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছায় ভোর ৪টায়। একঘণ্টা ধরে তারা কামানসহ নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করে।
এতকিছু ঘটে যাবার পরও মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স সেনাপ্রধানকে খবরটা জানায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে হামলা শুরুর পর। ডিজিএফআই প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফ ঘটনার কিছুদিন আগে সেনাবাহিনীর একটা অংশের সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে শেখ মুজিবুরকে জানায়। কিন্তু ফারুক-রশিদের তৎপরতা, অস্ত্র ও গোলাবারুদের সমারোহ, ট্যাংকসহ যাত্রা কিংবা রাষ্ট্রপতির বাসা ঘেরাও—কিছুই তারা জানতে পারেনি।
১৫ই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল মেজর জিয়াউদ্দিন। ভোর সাড়ে ৫টায় তিনি ডিজিএফআই মেস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথে মহাখালীতে আইল্যান্ডের ওপরে এবং রাস্তাপাশের খাদে ট্যাংক দেখতে পান। বর্তমান জাদুঘরের সামনে গেলে জনৈক সৈনিক এসে মেজর ডালিমের রেডিওতে ভাষণের কথা জানান।
অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ডিজিএফআই ইউনিটই রাষ্ট্রপতি হত্যার খবর জানতে পারে রেডিওতে মেজর ডালিমের ঘোষণা থেকে।