আমাদের ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধু একপ্রকার নিষিদ্ধই ছিল। মা বলতেন, “তোর জন্ম এরশাদের আমলে, স্কুলে ভর্তি হয়েছিস খালেদা জিয়ার আমলে, তখনকার বাতাসে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এইসব ছিল না।” ঐ সময়ের রেডিও, টেলিভিশন, বই, পত্রপত্রিকা কিংবা অন্য কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা ছিল না। ’৯১-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি যখন সরকার গঠন করে, তখন রেডিও টেলিভিশনে মেজর জিয়ার সেই পুরনো ভাষণটি প্রচার হয়। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সেদিনে বিকেলের দিকে টেলিভিশনে প্রচার হচ্ছে মেজর জিয়ার ভাষণ, বাবা বললেন—“অন বিহাফ অফ শেখ মুজিব, কথাটা কেটে দিয়েছে।” তখন এসব রাজনৈতিক জটিলতা বুঝবার মতো বয়স যে হয়নি সেটা বলা বাহুল্য। মা বাবার মুখেই প্রথম শুনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের কথা বঙ্গবন্ধুর কথা। বঙ্গবন্ধু কে, উনি দেশের জন্য কী করেছেন, এই উপমহাদেশ কত বড় মাপের নেতা পেয়েছিল এই ব্যাপারগুলো অনুধাবন করার শুরুটা বাবা মায়ের মুখে শোনা কথা থেকেই।
প্রায় রাতেই মা যুদ্ধের কথা বলতেন, একাত্তরের গল্প করতেন। শুনতাম, বঙ্গবন্ধু কিভাবে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। শুনতাম, ৭ই মার্চের ভাষণের কথা। পাকিস্তানী মিলিটারি বাহিনীর নৃশংসতার গণহত্যার কথা। মানুষের এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে বেড়ানোর কথা। ভিটেবাড়ি ফেলে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে শরণার্থীর কথা! আমার মায়ের বয়স তখন খুব কম সম্ভবত আট নয় বছর কিন্তু মায়ের বড় বোন আমার তিন মাসী তখন তরুণী। মিলিটারি আর রাজাকারদের ভয়ে তারা কেমন করে বাড়ির পিছনের বিলে কচুরীপানার ভেতর, কিংবা ঝোঁপেঝাড়ে মাটির গর্তে লুকিয়ে দিন রাত পার করতেন। সংখ্যালঘু হবার কারণে সর্বক্ষণ বাড়তি আতঙ্কে থাকার কথা। মা বলতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্টের কথা। কিভাবে মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র আর অসাধারণ দুঃসাহস নিয়ে যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখার গল্পও করতেন। বলতেন, “এদিকে দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, পাক মিলিটারিরা মুক্তি বাহিনীর কাছে মার খাচ্ছে, তাই ওরা শেখ মুজিবকে ভয় দেখানোর জন্য জেলখানার বাইরে কবর খোঁড়া শুরু করে। কিন্তু সে একটুও ভয় পায়নি, বুঝলি।”
বড় হয়ে বুঝেছি মায়ের গল্পগুলো ভীষণ আবেগ আর নানা (কল্পনা) স্বপ্ন মেশানো ছিল। আর তার বলার ধরন সব কিছু মিলিয়ে আমার শিশু মনে যা গভীর ছাপ ফেলেছিল। তা না হলে হয়তো আমি আজ মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুকে এতটা আপন করে ভালোবাসতে পারতাম না। কারণ তো আগেই বলেছি—আমাদের শৈশবে বঙ্গবন্ধু প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। মায়ের কাছে যুদ্ধের কথা শুনে আমার মন খারাপ হতো। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা শুনে মন খারাপ হতো। মা বলতেন, ছোট্ট রাসেল নাকি কেঁদেছিল, সে তাঁর মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা এই অবুঝ শিশুটিকেও মেরে ফেলেছিল। ঠিক রাসেলের বয়সী আমার একটি মেয়ে আছে এখন। মনে আছে, আমি ছোটবেলায় মায়ের মুখে রাসেলের কথা শুনে কেঁদেছিলাম। পরে রাসেলের ছবি দেখে আরোও অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে এত সুন্দর ফুটফুটে একটি বাচ্চাকে কিভাবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট মেরে ফেলল ওরা। এমনকি পাক-সেনারাও ১৯৭১ সালে যাদের মারেনি, তাদের কিনা এদেশেরই কিছু লোকজন মেরে ফেলল। এত সাধারণ ঘটনা একটি দেশের এমন এক নেতাকে পরিবারশুদ্ধ হত্যা করা। যার নেতৃত্বের প্রভাবে একটি ভূখণ্ড সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে।
বাবা আমাকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে। খুব সম্ভবত ৯৪/৯৫ সালের দিকে, বাবা একদিন অফিস থেকে বাসায় এসে বললেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি খুলে দেওয়া হয়েছে সবার জন্য। এই কথা শুনে আমি জেদ ধরেছিলাম আমাকে নিয়ে যেতে হবে। বাবা এমনিতে আমাদের কোথাও তেমন একটা বেড়াতে নিয়ে যেতেন না কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমাকে ঠিকই নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে আরো বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে। কিন্তু প্রথমবার দেখার স্মৃতি সম্পূর্ণ অন্যরকম। আসলেই কী সাধারণ ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবন-যাপন। এই বাড়ির জিনিসপত্র আবহ ঠিক আমাদের বাড়ি ঘরের মতোই কত আপন কত চেনা। একটি দেশের রাষ্ট্রপতির বাড়ি বলে মনেই হয়নি আমার।
মায়ের কাছ থেকে শোনা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গল্পটি ছিল, বঙ্গবন্ধুর সাথে মায়ের দেখা হবার গল্পটি। আমার নানাবাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জ, বুড়িগঙ্গার নদীর অপর পাড়ে পানগাঁও নামের একটি জায়গায়। তখন মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। একদিন মা শোনে কী যেন এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আসবেন নদী তীরের জেটিতে। মা-সহ স্কুল পড়ুয়া আরো কিছু বাচ্চাকাচ্চার সেখানে যেতে হবে। মা সেদিন অন্য বাচ্চাদের সাথে ভয়ে ভয়ে গিয়েছিলেন, খুব কাছ থেকে নাকি দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। মায়ের কথা অনুযায়ী, “উনি এত সাধারণ কোন পাইক পেয়েদা ছাড়াই একটি জিপে চড়ে ঐ অনুষ্ঠানে আসছিলেন। আমরা একদম তাঁর কোলের কাছে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলাম। আমাদের বিস্কুট আর গুঁড়াদুধের প্যাকেট দিছিলেন।”
মায়ের কাছে বঙ্গবন্ধুর গল্প শুনতে শুনতে আমি নিজেও যেন মায়ের চোখ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেতাম। মায়ের শৈশবকে আর আমার শৈশব ভাবতাম। আরেকটু বড় হয়ে টিভিতে বইতে পত্র-পত্রিকায় যখন দেখেছি—বঙ্গবন্ধুর ছবি ভিডিও গান দেখেছি তাকে নিয়ে লেখা পড়েছি তখন সেই অনূভুতিটা হয়নি হয়েছে অন্য আরেক অনূভুতি। যে মানুষটার কথা শুনতে একাত্তরের ৭ই মার্চ অগণিত মানুষ এসে জড়ো হয়েছিলেন রেসকোর্সের ময়দানে, যে অসংখ্য মানুষ বাহাত্তর সালের দশ জানুয়ারি আবেগ আপ্লুত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বদেশে বরণ করে নিয়েছিলেন—তারাই পরে কেমন করে বিভক্ত হয়ে গেলেন? ছোটবেলাতে ভাবতাম একই দেশের মানুষ আমরা, আমাদের একটাই পতাকা একটাই মাতৃভূমি একটাই জাতীয় সঙ্গীত, অথচ জাতির জনককে একদল পছন্দ করি; আরেকদল করি না। বড় হয়ে বুঝতে শেখার পর অবশ্য এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো ভালোভাবে জানার চেষ্টা করছি বোঝার চেষ্টা করছি। এবং বুঝতে পারছি এই বিভক্তির শিকড় একাত্তরে নয় বরং আরো সুদূর অতীতে।
মা বলতেন, “বুঝছিস বিপাশা, পৃথিবীর আরো অনেক দেশের জাতির জনক আছে, সেসব দেশের সব দলমত ধর্মের লোকেরা সবাই তাদের জাতির জনককে মানে শ্রদ্ধা করে, যেই দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সব সরকারি দপ্তরে সব সময় তাদের জাতির পিতার ছবি ঝুলায়ে রাখে। খালি আমাদের দেশেই মানুষ এমন উল্টাপাল্টা করে। একদল আইসা উঠায় আরেক দল আইসা নামায়।” এসব তো আমার শৈশবের কথা। এখন হয়তো অবস্থা পাল্টেছে অনেকটা, সেটা করতে অনেকটা সময় লেগেছে। স্বাধীনতার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বছরের পর বছর ধরে তার বিরুদ্ধে চলা প্রপাগন্ডা অপপ্রচারে দাগ মুছে তাঁকে আবার তাঁর সত্যিকারের আসনে বসানোটা সহজ কাজ না। বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধু কে? কী? কেন তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ? দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে তাঁর ভুমিকা কতটা শক্তিশালী? তাঁর নেতৃত্ব কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল যাতে করে একটি ভূখণ্ড সার্বভৌমত্ব অর্জনের পথে যায়? কে জানে এদেশ একজন বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিল বলেই হয়তো কাশ্মীর বা বেলুচিস্তান না হয়ে পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ হয়েছে। এসব কিছু আমার শৈশবে স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে কেউ শেখায়নি জানায়নি। হঠাৎ একদিন শুনি স্কুলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতা!
পরে বুঝেছি। সেটা ছিল ১৯৯৬ সাল। আর এখন আমাদের বাচ্চাদের জন্য বঙ্গবন্ধুকে জানার কত ব্যবস্থা। গল্প, কবিতা, কমিকস, নাটক, গান, চলচিত্র, চিত্রাঙ্কন কতকিছু। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, এত আয়োজন এত চাকচিক্য দিয়েও কি বঙ্গবন্ধুর আসল কারিশমাটা কি শিশুদের বোঝানো যায়? এসব দিয়ে কি শিশুদের অনুভব করানো যায় সে আবেগ যা আমি মায়ের মুখে শুনে শুনে অনুভব করেছি। এমন কোনো প্রবন্ধ গল্প নাটক অথবা চলচ্চিত্র আজও কি হয়েছে যেটা আমার সেই আবেগের জায়গাটা ছুঁতে পারবে?
আমার মা বাবা দুজন সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। মা দীর্ঘদিন হাইকোর্টের পেপারব্যাক শাখায় ছিলেন, তারপর সুপ্রিমকোর্টের লাইব্রেরি শাখায় কাজ করেছেন। চাকরির সুবাদে মা প্রায়ই বিভিন্ন মামলার নথিপত্র পড়ার সুযোগ পেতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিবরণী কিছুটা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। পরে বুঝেছি মা অনেক আবেগ কল্পনা মিশিয়ে তার শিশু সন্তানকে যে গল্প বলতেন তার মধ্যে প্রচণ্ড এক সত্যের অনুভূতি ছিল। এভাবেই মা একে একে তার দুই ছেলে-মেয়ের ভেতর দেশপ্রেমের সঠিক শিক্ষার বীজ বুনে দিয়েছিলেন। এমনকি এই শিক্ষাটা আমি স্কুলে কিংবা বই পড়ে পাইনি। আমাদের স্কুলেও ছিল নানা মতের নানা আদর্শের শিক্ষক, বই-পত্রের বেলাতেও তাই। এর মধ্যে কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক সেটা বুঝে উঠতে সময় লেগেছিল। তবে মার কাছ থেকে পাওয়া অনূভুতিটা কখনো ম্লান হয়নি।
ক্লাস ওয়ানে পড়ুয়া আমার বড় মেয়ে নিসর্গ ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন নিয়ে কত উত্তেজিত ছিল। প্রস্তুতি নিয়েছিল ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার। কিন্তু কোডিভ-১৯ ভাইরাসজনিত কারণে সব অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে যায়। (জানি এতেও কিছু লোক খুশি হয়েছে, যাদের আসলে কোনো মাতৃভূমি নাই।) নিসর্গকে বুঝিয়ে বলেছিলাম—অনুষ্ঠান স্থগিত হয়েছে তো কী হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে যাওয়া সেটা তো কোনোদিন কোনো ভাইরাস স্থগিত করতে পারবে না।