জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন তখন বাংলাদেশের সর্বত্র ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসলীলা। মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের অভাব ছিল তীব্র। কলকারখানায় উৎপাদনও বন্ধ। সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করা এবং এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করারসহ সমস্যা ছিল অগণিত। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দেশের অবস্থার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ঠিক এভাবে—‘আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষ পেয়েছি, যাদের কিছুই নেই। আমি ৫ হাজার ৩০৩টি রান্নাঘর বসিয়েছি। প্রতিদিন এক লাখ লোককে খাবার দিই। দুর্ভাগ্যবশত আমার বহু লোক প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। এর জন্য অংশত দায়ী পাকিস্তান। কারণ তারা আমার কাছ থেকে সবকিছুই নিয়ে গেছে।’ সে সময় বিদেশি গবেষকদের ধারণা ছিল—‘বাংলাদেশের পঞ্চাশ লাখ মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাবে। দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।’ কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। অসংখ্য বাধা মোকাবিলা করেও সাফল্য আনার সক্ষমতা যে এ দেশের মানুষের রয়েছে এটি বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত পথে সবাইকে নিয়েই এগোনো সম্ভব। জনগণের প্রতি এই অবিচল বিশ্বাসই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার মূল শক্তি।
মাত্র সাড়ে ৩ বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন জাতির জনক। এর মধ্যেই বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তিনি। একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় এমন কোনো বিষয় নেই, যা তিনি স্পর্শহীন রেখেছেন। বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছেন সব উন্নয়নের শক্ত ভিত হিসেবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুর সাফল্যময় শাসনামল ও তার দর্শন নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়নি এবং নতুন প্রজন্মের কাছে এ বিষয়গুলো তুলে ধরার যথোপযুক্ত উদ্যোগও নেই। ফলে একটি চক্র আজও জাতির জনকের শাসনামল নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টায় চালায়।
বাঙালিদের কিভাবে দেখেছেন তিনি? তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এক জায়গায় (২১৪ পৃষ্ঠায়) তিনি লিখেছেন ঠিক এভাবে—‘প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালোবাসি।’
বাঙালির চরিত্রের নিখুঁত ব্যাখ্যাও করেছেন আরেক জায়গায়—(৪৭ পৃষ্ঠায়)“আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আর একটা হলো আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতেই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। ...যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যত দিন চিনবে না এবং বুঝবে না, ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।”
বাঙালিদের নিয়ে এর চেয়ে খাঁটি মূল্যায়ন আর কী হতে পারে!
এই বাঙালিদের জন্যই বঙ্গবন্ধুর বুকে ছিল গভীর ভালোবাসা। নির্বাচনের সময় একবার হেঁটে হেঁটে প্রচারণার কাজ চালাচ্ছেন, তখন এক হতদরিদ্র বৃদ্ধ মহিলার সঙ্গে দেখা। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য কয়েক ঘণ্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে ধরে নিজের কুঁড়েঘরে নিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা দিয়েছেন, বলেছেন, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছু নেই।’
এ ঘটনা তার মনে দাগ কাটে। সেই দিনের অনুভূতি বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন (২৫৬ পৃষ্ঠায়) এভাবে—“নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।” জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তার এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেননি। তিনি বাংলার মানুষকে কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন সেটি তার প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। একবার এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘What is your qualification?’—উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘I love my people.’ ওই সাংবাদিক সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘What is your disqualification?’ বঙ্গবন্ধু শান্তকণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘I love them too much.’
কেমন দেশ চেয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব? সেটি অনুমান করা যায় তার নানা বক্তব্য বিশ্লেষণে। স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে তিনি বলেছিলেন—‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি, যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।’
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে দুর্নীতির বিরদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেছিলেন—‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে জাতির ভবিষ্যত অন্ধকারে ছেঁয়ে যাবে।’ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাচালানি, মজুতদারি, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু বলেন—‘এদের শায়েস্তা করে জাতীয় জীবনকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে আওয়ামী লীগের দুই যুগের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের গৌরবও ম্লান হয়ে যেতে পারে।’ বঙ্গবন্ধুর দর্শনও ছিল দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন। যা অনুসরণ করার চেষ্টা করছেন তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে সেনাবাহিনীর কিছু কুলাঙ্গার বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বহু সংখ্যক সদস্যসহ হত্যা করে। বিশ্ব ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। ফলে থেমে গিয়েছিল বাংলাদেশের উন্নয়নের সম্ভাবনাময় অভিযাত্রা। তাঁর অবর্তমানে দেশ চলতে শুরু করে উল্টো পথে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু কখনোই কারো সঙ্গে আপোস করেননি। নিজের পরিবারের দিকে লক্ষ্য না করে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাই এই বাংলায় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই। তাঁর আদর্শেরও মৃত্যু ঘটবে না কখনো।