যখন নতুন রাষ্ট্র রূপে স্বাধীন বাংলাদেশ কেবল তার যাত্রা শুরু করেছে, তখন তার সামনে ছিল পাহাড়প্রমাণ সমস্যা। যার সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা। এমতাবস্থা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এক গভীর ষড়যন্ত্রেও অংশ। পরবর্তীতে জাতীয় চারনেতার হত্যাকা- হত্যার রাজনীতির নতুন ক্ষত সৃষ্টি করে এবং এসব নৃশংস হত্যাকা- সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।
পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর ব্রিটেন ও ভারত হয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দীর্ঘ আন্দোলনের সফলতায় যে স্বপ্নের বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে, তা পুনর্গঠনের প্রত্যয়ে তিনি তখন দীপ্ত। যুদ্ধের ফলে বিধ্বস্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রতীতে তিনি শুরু করেন জীবনের আরেক অধ্যায়।
অনেকে ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নেবেন না। কারণ, তিনি তখন আর দলীয় নেতা নন, সমগ্র বাংলাদেশের আপামর মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু বাঙালির স্বার্থে ও বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি সরকারপ্রধান হন। ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সরকার ঘোষণা করে ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’। ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল ২ হাজার ৮৪৮ জনের। দ-প্রাপ্ত হয় মাত্র ৭৫২ জন দালাল তথা পাকিস্তানি দোসর। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
একই সময়ে বঙ্গবন্ধু মনোযোগ দেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো বিনির্মাণের কাজে। শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করে তিনি শিল্প-উৎপাদনের ৮৫ ভাগ সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এদিকে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে আশানুরূপ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় খরা ও মন্দা দেখা দেয়, যা ছিল যুদ্ধে প্রায়-ধ্বংস দেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় স্বরূপ। খরাজনিত দুর্ভিক্ষের কারণে সৃষ্টি হয় নানামুখী সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, যা মোকাবেলা করার কঠিন চ্যালেঞ্জ সরকারকে নিতে হয়। প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় অর্থের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকার দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। যদিও তখন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে কিছু অসন্তোষ ধূমায়িত হয়, যার নেতৃত্ব দেয় অতি-ডান ও অতি-বাম উগ্রবাদী দলগুলো।
সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনে একই সময়ে পুঞ্জিভূত হতে থাকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ¯œায়ুগত লড়াই, যার একদিকে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ আর বিপক্ষে পাকিস্তান প্রত্যাগতরা। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তৎকালে কর্মরত বাঙালি সৈনিকের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫০ হাজার। যাদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার আটক ছিল পাকিস্তানে। বাংলাদেশে যে ১৪-১৫ হাজার সৈন্য ছিল, তাদের অনেকেই যুদ্ধে আহত-নিহত হন আর বাদবাকী অধিকাংশই ছিল যুদ্ধাহত, পঙ্গু ও রণক্লান্ত। তাদের পক্ষে এসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রাধান্য ঠেকানো ও অপতৎপরতা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় নি। ফলে প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের দাপট বাড়তে থাকে, যারা সরকারকে নানাভাবে বিব্রত ও স্যাবোটাজ করতে থাকে।
এমতাবস্থায় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নতুন দেশের নতুন সরকারের অধীনে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ধারা দৃঢ় ও অব্যাহত রাখার জন্য নির্বাচন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে নির্বাচন শতভাগ বিতর্কহীন হতে পারে নি। বিরোধী দলগুলোও হটকারিতা ও নানা সমালোচনায় মুখর হয় নির্বাচন প্রসঙ্গে। যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে বিপুল বিজয় পাবে, তা ছিল খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন না করায় আশানুরূপ ফল লাভে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো তখন চরমভাবে সমালোচনা ও আন্দোলনমুখর হয় এবং অতিউগ্র কিছু দল নাশকতামূলক কার্যক্রম শুরু করে। ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী’ নামে একটি নতুন সশস্ত্র সংস্থা গঠন করে, যার কার্যকলাপ নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে বির্তক সৃষ্টি হয়। তদুপরি, অপরাপর বাহিনীগুলোর সঙ্গে এই নতুন বাহিনীর দূরত্ব ও মতপার্থক্যও দেখা দেয়।
এতকিছুর পরেও দেশকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় পরিচালনার জন্য সরকার সচেষ্ট হয়। সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যুদ্ধের ক্ষত নিয়েই সংসদীয় ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অব্যাহত রাখে। এমন কৃতিত্ব যুদ্ধ-পরবর্তী দেশগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ। যদিও দেশে তখন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর, প্রশাসন, সিভিল সোসাইটি ও রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং আইন-শৃঙ্খলা নাজুক। নানা রকমের অন্তর্দ্বন্দ্ব পেরিয়ে সরকার শাসনের ধারা অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট হয়। যদিও সরকার দলের ছাত্র সংগঠনের ভাঙনের ফলে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠিত হয় নতুন দল জাসদ, যারা তীব্রভাবে বিরোধিতার রাজনীতি শুরু করে। সরকার এসব সামাল দিয়েও দেশের জন্য নানা রকমের নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে চলতে থাকে। যার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ড. কুদরাত-ই-খুদার শিক্ষা কমিশন অন্যতম। সরকার ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি করে, বিরোধীরা যার তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়। সরকার-বিরোধী আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হয়ে দুনীতি, স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে সরব হয় এবং দেশব্যাপী আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়। এর ফলে মৌলিক অধিকারসমূহ স্থগিত হয়। এর ২৭ দিন পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। ৭ জুন দেশে একক জাতীয় দল হিসাবে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করা হয়, যাতে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সৈনিক, আমলা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের নেওয়া হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’।
গবেষকরা মনে করেন, প্রতিকূল অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামাল দিতে বঙ্গবন্ধু ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর সূচনা করেছিলেন। এতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। দ্রব্যমূল্য ও অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এদিকে ১ সেপ্টেম্বর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ তথা ‘বাকশাল ব্যবস্থায়’ নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু হত্যার এই নির্মম ঘটনার চার মাস পর ৩ নভেম্বর নিরস্ত্র অবস্থায় জেলে নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চার জাতীয় নেতা: সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে তাঁদের প্রত্যেকের নাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। দীর্ঘ ২৫ বছর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করার সাধনায় নিয়োজিত থাকার পর তাঁরা স্বাধীনতার নয় মাস জাতির মুক্তির লক্ষ্যে জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব প্রদানকারীদের হত্যার মাধ্যমে এটা “বোঝা গেল যে, হত্যাকারীদের ক্রোধ কেবল বঙ্গবন্ধু-পরিবারের মধ্যে সীমিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও সে আদর্শের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোও ছিল তাদের আক্রোশের লক্ষ্য” বলে মনে করেন বদরুল আলম খান তার সংঘাতময় বাংলাদেশ: অতীত থেকে বর্তমান, (ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৫, পৃ. ২১৯) গ্রন্থে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।