একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়নে রেখেছিলেন অনন্য ভূমিকা। খেলাধুলা একটি জাতির মন ও মানস গঠনে এবং বিশ্বের বুকে পরিচয় এনে দিতে যে দারুণ ভূমিকা রাখে, সবসময় এই ব্যাপারটি স্মরণে রেখেছিলেন তিনি। সেজন্য নিয়েছিলেন নানান অসামান্য উদ্যোগ এবং করেছিলেন সেগুলোর বাস্তবায়ন। ক্রীড়াবিশ্বে বাংলাদেশ আজ আপন দ্যুতিতে ভাস্বর। এর যাত্রাটি বঙ্গবন্ধুর আমলে শুরু হয়েছিল বললে অত্যুক্তি হবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগাগোড়াই একজন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ ছিলেন। কেননা তিনি নিজেও একসময় ছিলেন ফুটবল খেলোয়াড়। সেই আমলের বিখ্যাত ও সফল ক্লাব ওয়ান্ডারার্সের হয়ে মাঠ মাতিয়েছিলেন। খেলাধুলাকে কতটা ভালোবাসতেন তিনি, সেটির প্রামাণ্যচিত্র তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি। এক ক্রীড়াপ্রেমী পরিবারে জন্ম নেওয়া বঙ্গবন্ধুর যে খেলাধুলার প্রতি গভীর টান ছিল সেই ছাত্রাবস্থা থেকে—সেটি খুব সুন্দর করে ফুটে উঠেছে আত্মজীবনীতে। এছাড়াও তরুণ বয়সে খেলতেন ভলিবল এবং হকিও। এথেকেই বোঝা যায়, শুধু ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলার প্রতি ছিল তাঁর দুর্বলতা।
ক্রিকেটের প্রতিও তাই ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার তাগিদে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড’ গঠন করেন—যা বর্তমানে ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড’ বা বিসিবি নামে পরিচিত। দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য ১৯৭২ সালেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা’। এটি এখন পরিচিত ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ’ নামে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত এই ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এটি নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাধীন ৪৫টি ভিন্ন ভিন্ন খেলাধুলা বিষয়ক সংস্থাকে।
তাঁর আমলেই ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বা বাফুফে। বাংলাদেশের ফুটবলে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এটি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণা আর আন্তরিক সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলাদেশে ফুটবল মাঠে গড়ায় মাত্র দুমাসের মধ্যেই। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল ম্যাচ। তৎকালীন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) দেশের তারকা ফুটবলারদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ একাদশ ও রাষ্ট্রপতি একাদশের মধ্যে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা দল কলকাতা মোহনবাগান ঢাকায় খেলতে আসে ১৯৭২ সালের মে মাসে। প্রথম ম্যাচে কলকাতা মোহনবাগান ঢাকা মোহামেডানকে হারালেও পরের ম্যাচে হোঁচট খায় সফরকারীরা। দ্বিতীয় ম্যাচে মোহনবাগান ঢাকা একাদশের মোকাবেলা করে। খেলার আগে ঢাকা একাদশের খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করেছিলেন জাতির জনক। ম্যাচের দিন প্রধান অতিথি হিসেবে মাঠে উপস্থিত থেকে চাঙ্গা করেছিলেন খেলোয়াড়দের মনোবল। বঙ্গবন্ধুকে সেই দিন দুর্দান্ত এক জয় উপহার দিয়েছিলেন ফুটবলাররা। উজ্জীবিত ঢাকা একাদশ ১-০ গোলে হারায় মোহনবাগানকে। ঢাকা একাদশের পক্ষে সেই দিন জয়সূচক গোলটি করেছিলেন বর্তমানে সাফ এবং বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে খেলতে আসে রাশিয়ার মিন্সক ডায়নামো ক্লাব। ক্রীড়াপ্রেমী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাঁর ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে নিয়ে ভিআইপি গ্যালারিতে বসে উপভোগ করেন ঢাকা একাদশ এবং রাশিয়ার মিন্সক ডায়নামো ক্লাবের খেলা। ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়েছিল ফুটবল দল। খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করতেই জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় দলের বিদেশ যাত্রার আগে তাদের ডেকে নেন গণভবনে। দলের সবার সঙ্গে কুশলবিনিময় করে ছবিও তুলেছিলেন, দিয়েছিলেন অনুপ্রেরণার সঞ্জীবনী।
এভাবে বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবনটিই যেন একজন ক্রীড়াপ্রেমীর প্রতিচ্ছবি। তার দেখানো পথেই আজ এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট নির্মম, অপরিণামদর্শী ঘাতকের বুলেট তাঁর প্রাণ কেড়ে নিলেও, খেলাধুলার প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও অবদানের জন্য দেশের ক্রীড়ামোদী মানুষের মনে নিঃসন্দেহে চিরদিন জাগরূক থাকবেন তিনি।