১৯৯০ সাল। আগস্টের তিন তারিখ। সিউল থেকে ফেরার সময় সিংগাপুর এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি, ঢাকাগামী কোনো কানেকটিং ফ্লাইট পাওয়া যায় কিনা। মধ্যরাত। ব্যস্ত এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জ তখনও জমজমাট। এরমধ্যে রাতটুকু কাটাতে হবে। এই রকম পরিবেশে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা নিরিবিলি জায়গায় চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছি। আমার সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা প্লেন ভ্রমণের ক্লান্তি। এসময় পাশের চেয়ার থেকে একজন বললেন, “তুমি কোথায় যাবে?”
অনুমান করে বলা যায়, ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। কণ্ঠ এবং চাওনির মধ্যে মাদকতা আছে। আমি খুব অভিভূত কণ্ঠে বললাম, “ঢাকায়।”
“ঢাকা, বাংলাদেশ?”
“হ্যাঁ, বাংলাদেশ। আমার জন্মভূমি।”
ভদ্রলোক খুব উৎসাহী হয়ে বললেন, “তোমাদের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ, তোমার দেশে সারাবছর প্রচুর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করে। আমার সরকার তোমাদের প্রচুর ডলার পাঠায়, সেই ডলার দুর্নীতিতে আক্রান্ত হয়।”
আমি বললাম, “তোমার দেশ, নাম, পেশা?”
“আমার নাম জর্জ ব্রুক। বাড়ি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে, পেশায় ইঞ্জিনিয়র, ম্যানিলা যাচ্ছি একটি সেমিনারে যোগ দেবার জন্য।”
আমি বললাম, “আমরা দরিদ্র। আমাদের অর্থনৈতিক ভিত খুব শক্ত নয়। কিন্তু তোমার দেশে কি অসৎ লোক নেই? সব সমাজ ব্যবস্থায়ই এই শ্রেণির লোকের জন্ম হয়। দীর্ঘকাল পর স্বৈরতন্ত্রের কালো ছাপ মুছে নতুন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি আশাবাদী।”
দূর দেশ। অযাচিতভাবে একজন বিদেশির মুখে নিজ দেশ সম্পর্কে কথা, কার না ভালো লাগে। গর্ব নিয়ে জর্জের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। ঠিক তখন জর্জ বললেন, “গর্ভাচেভ কি শেষ পর্যন্ত সোভিয়েতকে ধরে রাখতে পারবে?”
জর্জকে আমার পাগলাটে স্বভাবের মানুষ মনে হয়, যার চিন্তা দ্রুত পরিবর্তিত। তারপরও বললাম, “আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েতের ভূমিকা স্মরণ করে মহান লেনিনের দেশের জনগণের সমৃদ্ধি কামনা করছি।”
জর্জ খুব মিষ্টি করে হাসতে পারে। তার মধ্যে তারুণ্যের প্রকাশও আছে। যা কেবলই নিকটতম করতে বাধ্য করে।
এই সময় জর্জ আমাকে প্রশ্ন করে, “তোমরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেললে কেন?”
মধ্যরাত। ভিনদেশি এয়ারপোর্টে একজন বিদেশির মুখে এরকম প্রশ্ন আমাকে কাতর করে তোলে। বুকের ভেতর ধাক্কা খায়। সত্যি তো! আমরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেললাম কেন? আমাকে কতক্ষণ ভাবিত করে এই প্রশ্ন। জর্জ আমার দিকে উৎসুক তাকিয়ে থাকে। কয়েক মুহূর্ত আমাদের কথা হয় না। শুধু পরস্পরের উদাস তাকানো ছাড়া। আমার ভেতর জন্ম নেয় অপরাধবোধ। ক্লান্ত অনুভব করি। জর্জকে একজন পরাক্রমশালী মানুষ মনে হয়। জর্জের সঙ্গে কথা বলার সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। পলায়নপর মানসিকতা নিয়ে বলি, “এর সত্যিকার উত্তর আমি তোমাকে দিতে পারব না। কারণ, প্লেন ভ্রমণে ক্লান্ত আমি। তুমি যদি সত্যিকার অর্থেই জানতে চাও, কেন আমরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেললাম, তা তোমাকে জানাতে পারব। তোমাকে একটা চিঠি লিখতে চাই। অবশ্য আমার মাতৃভাষা বাংলাতে। তুমি কষ্ট করে কোনো দোভাষীর সাহায্যে জেনে নিও।”
পরদিন সকালে জর্জ ম্যনিলার প্লেন ধরবে বলে বিদায় নেবার আগে ওর ঠিকানা এগিয়ে দিয়ে বলে, “তোমার চিঠির প্রতীক্ষা করব। কারণ শেখ মুজিবের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে।”
দেশে ফিরে অনেক দিন ভেবেছি জর্জকে কী লেখা যেতে পারে? প্রথমত জর্জের মনে শেখ মুজিব একজন বিপ্লবী নেতা, সফল মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি, মানবিক যোদ্ধা হিসেবে কীর্তিমান। চিঠি পেয়ে জর্জ শেখ মুজিব সম্পর্কে কোনোরূপ বিভ্রান্তির মধ্যে থাক, তা আমি চাই না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাত্রিতে শেখ মুজিব হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি যে কলঙ্ক ধারণ করেছে, তা কি জর্জকে জানাতে পারি? এসব প্রশ্ন আমার।
এই সব প্রশ্ন নিয়ে জর্জ আমাকে তাড়া করতে থাকে। আজও করছে। তাই জর্জকে লিখতে হলো—
প্রিয় জর্জ,
তোমাকে লেখার মতো অতোটা সাহস আমার নেই। তবুও মনোভূমি জুড়ে তোমার কথাটি নিয়ে ভাবনায় তাগিদ অনুভব করেছি। আমি যে প্রজন্মের সন্তান, তার স্মৃতিতে একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা বর্ণাঢ্য অতীত রয়েছে। রয়েছে বীর্যবান বীরত্ব গাঁথা। সেই গর্বিত অতীত, যা শেখ মুজিবের মতো একজন মহান বাঙালি দেশপ্রেমিককে হত্যার মাধ্যমে কলঙ্কিত হলো। ব্যর্থ হলো হাজার বছরের বঞ্চিত জাতি যা অর্জন করেছিল।
জর্জ, জাতি হিসেবে আমাদের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য, সমৃদ্ধময় সংস্কৃতি আছে। তার যৎকিঞ্চিত তোমাদেরও জানা দরকার। ‘বঙ্গভূমি’ নামক বঙ্গোপসাগর পাড়ের এই ভূখণ্ডটি ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে সম্পদশালী সমৃদ্ধ দেশ। তার লোভে হাজার হাজার বছর ধরে বহিরাগত যেমন—হুন-মোগল-পাঠান-ইংরেজ প্রভৃতি জাতি ছুটে এসে লুট করেছে এ দেশের সম্পদ, সংস্কৃতি। মিশ্র বা শংকর হিসেবে চিহ্নিত জাতি। উপনিবেশিক বলয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল, স্বাদ পায়নি। সর্বশেষ প্রভু ইংরেজ চলে যাবার পর ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করে নতুন দুটো রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান ভৌগোলিক দিক দিয়ে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান দুটো প্রদেশ। মাঝখানে ভারত। দুই প্রদেশের ভৌগোলিক ব্যবধান চৌদ্দশ মাইল। ভাষা-সংস্কৃতির অমিল বিদ্যমান। শুধু ধর্মীয় অনুশাসনকে প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তানের জন্ম। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষী মানুষের বসবাস। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দু। ব্রিটিশ ও তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতির সিংহ পুরুষেরা দ্বিজাতিতত্ত্বের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করে। তাদের রাজনীতির মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহৃত হয় সবচেয়ে বেশি। বলা যায়, পরবর্তী সময়ে এটা একটা সুস্থ-সুকুমার জাতি গঠনে সহায়ক হয়নি।
বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড দুটি দেশে বিভক্ত। পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গ পৃথকিকরণের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশ। পূর্ববঙ্গ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম। সেই পূর্ব পাকিস্তানের জন্মলগ্নে বাঙালি জাতি প্রথম আঘাতপ্রাপ্ত হয় ভাষার প্রশ্ন নিয়ে। ’৪৮ সালেই এ প্রদেশের মানুষ টের পেয়ে যায় পাকিস্তানের প্রিয় জাতির পিতা কর্তৃক শাসিত বাঙলা ভাষা প্রশ্নে আধিপত্য নীতি। বাঙালি জাতিতে শাসন ও শোষণের বিষবৃক্ষ রোপিত হয় ঠিক ওই সময়ে। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে হাজার বছরের লালিত বাঙলা ভাষার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রাধান্য প্রতিহত করে রাষ্ট্রীয় জীবনে বাঙলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়।
যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছে। তারপরও পাকিস্তানের জন্মলগ্নে মি. জিন্নাহ যে শাসনের খড়গ স্থাপন করে, তা পাকিস্তানী শাসনের ২৩ বছরেও বিদ্যমান ছিল। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করে, এক দেশে দুটো সংস্কৃতির পাশাপাশি অবস্থান সঠিক নয়। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানী মুসলমান ভাইয়েরা পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমান ভাইয়ের ওপর অর্থনৈতিক বৈষম্যের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটায়।
পরবর্তী সময়ে ’৫৪ নির্বাচন, ’৫৬ সালে মাওলানা ভাসানীর ‘ওয়ালেকুম’ শাসককূলের প্রসাদ ষড়যন্ত্র সাম্প্রদায়িক চরিত্র বিকাশ বিষয়গুলোর নেতৃত্বের ওলট-পালট ডামাডোলের সময়ে প্রাথমিকভাবে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চারিত্র নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যুদয়। তারপর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ’৬২-এর ছাত্র-আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সর্বোপরি ’৭০-এর নির্বাচন। সবমিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে আলাদা বাঙালি সত্তায় জেগে ওঠার প্রকাশ ঘটায়। আর তার মহান নায়ক শেখ মুজিব এবং তার সংগঠন আওয়ামী লীগ। ৪৭-এর দেশভাগের মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয়, পাকিস্তানের শাসনের মধ্যে বাঙালি মুসলমানের উপস্থিতি শূন্য। আর একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয়। ৪৭-৭০-এর পাকিস্তানি শাসকরা এই বিষবৃক্ষই লালন করেছে। যার ফলেই বাঙালি আত্মানুসন্ধান করেছে হাজার বছরের বাঙালি চরিত্রের বীর্যবান ইতিহাস। আর সে সময়ের মহান ফসল ‘শেখ মুজিব’। হাজার বছরের অনন্য কণ্ঠস্বর শেখ মুজিব পলিবাহিত এদেশের বঞ্চিত মানুষের প্রতিভূ হয়ে পাকিস্তানি শাসন আমলে সূর্যের আলো নিয়ে ভাস্বর।
উল্লেখ্য, ৪৯-এর উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজিত হওয়ার ঘটনা ক্ষমতাসীনদের সন্ত্রস্ত করেছিল। যা পাকিস্তান রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে প্রতিটি আন্দোলনে জনবিচ্ছিন্ন মুসলিম লীগ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সামরিকতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এ প্রতিবাদী ধারাবাহিকতায় বাঙালিরা জেল জুলুম, রাজপথে রক্তক্ষয়, সামরিক শাসন উপেক্ষা করে নিজেদের সংগ্রামী করে তুলেছে।
জর্জ, তোমাকে একটি বিষয় জানিয়ে রাখি, ’৪৭-এর দেশভাগের পর পাকিস্তানেও কখনো গণতন্ত্রের চর্চা হয়নি। অর্থাৎ ৪৭-৭০ এই তেইশ বছর সামরিক শাসনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের প্রস্তুত করেছে। আর সামরিক বাহিনী দেশের গণতন্ত্রী দলগুলোকে দমন করার জন্য মৌলবাদী দলগুলোর ওপর সওয়ার হয়েছে। প্রাসাদ রাজনীতির চরিত্র এভাবেই আমাদের মধ্যে আমূল প্রোথিত হয়।
শেখ মুজিবের নিরলস সংগ্রাম, যা এ মাটির মানুষকে যুদ্ধের ময়দানের দিকে নিয়ে গেছে। শেখ মুজিব ছিলেন অসম্ভব পরিশ্রমী, অনন্য সংগঠক, নিপীড়িত জনগণের ঘনিষ্ঠজন। কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রথম আসামী হিসেবে অভিযুক্ত শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি সামরিক শাসক জেলখানায় আটকে রাখতে পারেনি, শুধু এ জন্য যে, পাকিস্তানি রাজনীতিতে শেখ মুজিবই কেবল মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিল।
সামরিক শাসনের মধ্যেই ’৭০-এর গণ রায় যা সমস্ত বিশ্বকে অবাক করে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জনই শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি তিনভাগের একভাগ সিট পেয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবি করলেন। অর্থাৎ সামরিকতন্ত্রের আবার প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। এই নিয়ে বাকবিতণ্ডা চলে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক রাস্তায় রক্তপাত ঘটতে থাকে। আমাদের দেশের গরিব মানুষের পয়সায় কেনা অস্ত্র জনগণের ওপর প্রয়োগ করা শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাঙালি হত্যা হচ্ছে।
শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। যা একটি জাতিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শেখ মুজিব রাজনৈতিক জীবনে কিছু কিছু পদক্ষেপ অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ ৪৭-৭১ পর্যন্ত শেখ মুজিব সময়ের শ্রেষ্ঠ ফসল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রির কথা তুমি জানো! পৃথিবীর সমস্ত সংবাদ নেটওয়ার্ক ফলাও করে প্রচার করে পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক বাঙালি নিধনের নির্মম চিত্রাবলি। বাঙালি জাতির সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
মূলত ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ ছিল আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিব পরিচালিত একটি সফল ‘জনযুদ্ধ’। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। আন্তর্জাতিক চাপ, ৭১-এ ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি, রাশিয়ার অকুণ্ঠ সমর্থন, সমগ্র পৃথিবীর অধিকাংশ শান্তিকামী মানুষ আমাদের এই মহান বিজয়কে ন্যায়সঙ্গত মনে করেছে।
তার প্রেক্ষাপটে ৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তিলাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশে পদার্পণ করে। ‘বাংলাদেশ’ নামক এই ভূখণ্ড তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার। তার সে স্বপ্ন সফলতা লাভ করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এখানকার মৌলবাদী সংগঠন মুসলিম লীগ, জামায়াত ইসলামী, রাজাকার, আলবদর, আল শামস গঠন করে প্রভু হানাদার বাহিনীকে স্বগোত্রীয় করে বাঙালি নিধনের যে নজির স্থাপন করে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে এইসব হায়নাদের ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেন। বলা বাহুল্য পরবর্তীতে আবার এরাই শেখ মুজিব হত্যাকে ত্বরান্বিত করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন কোমল হৃদয়ের মানুষ। সাধারণ মানুষের মুক্তির অকুতোভয় সৈনিক। যে মানুষেরা হাজার বছর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বঙ্গবন্ধুর মতো মহান বাঙালি হয়তো নতুন করে আর রক্তপাত চায়নি। এই সাধারণ ক্ষমা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কিন্তু জর্জ, সাপের স্বভাব ছোবল দেওয়া, তাকে তুমি যতই দুধ-ভাত দাও না কেন। যদি হৃদয়বেত্তা দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করি, তবে শেখ মুজিব সঠিক ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের কলাকৌশল হিসেবে হয়তো সঠিক নয়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না মানুষটি শেখ মুজিব।
’৭২ সালে শেখ মুজিব ক্ষমতা আরোহণের পরপরই শুরু হয় স্বদেশি এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিব। যার সম্বল কেবল জনগণের ভালোবাসা। সে দেশের হাল ধরে শেখ মুজিব দিশেহারা। তবুও জনগণ তাঁর প্রতি আস্থাশীল। নতুন একটি জাতি পুনর্গঠনকল্পে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বিশ্ববাসী সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। এই সময় দেশের প্রতিক্রিয়াশীল দল, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশীয় শত্রুরা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতার মহান প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে শুরু হয় মার্কিনী ষড়যন্ত্র। তার ফল ’৭৪ সালে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুকে জনগণের নিকট অপ্রিয় করার চেষ্টা।
যখন শেখ মুজিব এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন দলীয় কিছু সংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ, আদর্শচ্যুত নেতা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। যোগ দেয় সুবিধাবাদী আমলা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চরিত্রগুলো।
১৯৭৫ সালে জাতীয় সরকার গঠনকল্পে বাকশাল প্রবর্তন বঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেয়। যা জনগণের জন্যে সত্যিকার অর্থে মঙ্গলজনক ছিল। কিন্তু সময়টা তার জন্য সঠিক ছিল না। অর্থাৎ সমগ্র জীবন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সময়কে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে গেছেন। ’৭৫ সালে বাকশাল গঠন করা তাঁর জন্য সঠিক হয়নি। যে কাজটি তিনি ৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে করতে পারতেন!
আজন্ম গণতন্ত্রী শেখ মুজিবর বাকশাল গঠন করে যে দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রচার মাধ্যম এটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এই একদলীয় শাসনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। আর এসময় আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, দেশীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চরিত্রগুলো প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের যে নজির স্থাপন করে তার ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালোরাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হন।
আমার কী মনে হয় জর্জ, জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ! যে মানুষটি একটি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁর সর্বশেষ রক্তবিন্দু মিশে আছে তার স্বদেশে। তাঁকে তাঁর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছি।
তাই তুমি যখন প্রশ্ন করো, আমরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেললাম কেন? তখন এই প্রশ্ন আমাকে কাতর করে। তবে মুজিব সম্পর্কে আমার চিন্তা তোমাকে জানাতে পারি।
শেখ মুজিব মগজের চেয়ে হৃদয় দ্বারা চালিত হতেন বেশি। আর এধরনের মানুষেরা হৃদয়বান হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। হাজার বছর ধরে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন হৃদয়বান, দেশপ্রেমিকের জন্ম উপাখ্যানের মতো। ৪৭-৭২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে, শেখ মুজিবের রাজনীতিকালে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে স্বপ্ন জাগ্রত হয়েছিল তার চূড়ান্ত উন্মোচন ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির স্বপ্নপুরুষ শেখ মুজিব। তাঁর হত্যার মধ্যে স্বপ্নভূক মানুষেরা স্বপ্নহীন হয়েছে। তাঁর কাছে জনগণের প্রত্যাশা বেশি বলে কষ্টের তাপ অসহনীয়। তবুও সম্ভবত শেখ মুজিব জনগণকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। আমি যে ভূখণ্ডের আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি তার স্থপতি হত্যার অপরাধী হিসেবে আমাকে দায়ী করার জবাব দিতে পারি না। তুমি কি আমায় ক্ষমা করবে?
ইতি ভবদীয়
একজন অক্ষম বাঙালি সন্তান