গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই বঙ্গবন্ধুর জীবনে কয়েকটি ঘটনা ঘটে। অল্প বয়সে তাঁর মধ্যে যে মহানুভবতা, ঔদার্য, সাধারণ মানুষের প্রতি আন্তরিক দরদ, সৎ সাহস, মানুষের বিপদে-আপদে অকুণ্ঠচিত্তে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, সমাজের যে কোনো স্তর ও পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশা প্রভৃতি গুণাবলির প্রকাশ ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভালো ফসল না হওয়ায় একবার টুঙ্গিপাড়ায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। গাঁয়ের অধিকাংশ মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হয়। গোপালগঞ্জ থেকে টুঙ্গিপাড়া এসে সব দেখে তাঁর মন কেঁদে ওঠে। তারপর বাবার অনুপস্থিতিতেই তাঁদের গোলার সঞ্চিত ধান অভাবগ্রস্ত মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন। বাবা বাড়ি এসে সব শুনলেন, দেখলেন। বঙ্গবন্ধু এসে পিতাকে অকপটে বললেন, অভাবগ্রস্ত মানুষের কষ্ট সহ্য করতে না পেরেই তিনি নিজেদের গোলার বাড়তি ধান তাদের মধ্যে বিতরণ করেছেন, তাদের বাঁচার ব্যবস্থা করেছেন। বাবা চিনতেন তার সন্তানকে। তাই কিছু বলেননি, বরং নিঃশব্দে পুত্রকে ক্ষমা করে প্রাণভরে দোয়া করেছিলেন।
মিশন স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু স্কুলের শিক্ষক রসরঞ্জন সেনগুপ্তের বাড়িতে প্রাইভেট পড়তেন। একদিন সকালে তাঁর বাড়ি থেকে পড়া শেষ করে ফিরে আসার পথে এক খালি গা বালককে দেখে নিজের গায়ের গেঞ্জি ও লুঙ্গি খুলে দিয়ে এসেছিলেন এবং বাড়ি ফিরেছিলেন গায়ের চাদর পরে। বালকের কষ্ট কিশোর বঙ্গবন্ধু সেদিন সহ্য করতে পারেননি। সেদিনও বাড়ি গিয়ে বাবাকে সবকথা খুলে বলেছিলেন তিনি। এছাড়া কোনো গরিব ছেলে রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট পাচ্ছে দেখলেই বঙ্গবন্ধু তাঁর ছাতাটি তাকে দিয়ে আসতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে দিতেন।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় কিশোর বঙ্গবন্ধুর জীবনে আরো একটি ঘটনা ঘটেছিল। টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারকে না জানিয়ে এলাকার কয়েকজন ব্যক্তি নিকটবর্তী পাটগাতি বাজারে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় এবং এজন্য এলাকার অপরাপর সব গণ্যমান্য ব্যক্তিকে এক সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ শহর থেকে গ্রামে এসেছিলেন ছুটি কাটাতে। তিনি সব শুনলেন, জানতে পারলেন, তাঁর পরিবারের কাউকেই আমন্ত্রিতদের তালিকায় রাখা হয়নি। সভায় বঙ্গবন্ধু ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। এক পর্যায়ে ভিড় ঠেলে বঙ্গবন্ধু সোজা মঞ্চে উঠে যান এবং উচ্চ কণ্ঠে শ্রোতাদের বলেন, “যে সভায় আমাদের শ্রদ্ধেয় মুরুব্বীদের নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়, সে সভায় আমাদের থাকা উচিত নয়। চলুন এখুনি আমরা সভা ত্যাগ করে চলে যাই।” সভায় শেখ পরিবারের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন তাদের আত্মীয় বন্ধুরাও। তাছাড়া উপস্থিত অধিকাংশই শেখ পরিবারকে শ্রদ্ধা করতেন। তাই বঙ্গবন্ধু সভা পরিত্যাগের আহবান জানানোর সাথে সাথেই হৈ চৈ শুরু হয় এবং সভাটি পণ্ড হয়। পরে অবশ্য শেখ পরিবারের উদ্যোগেই পাটগাতিতে স্কুল স্থাপিত হয়।
বঙ্গবন্ধু যে বড় হয়ে একজন বড় মাপের মানুষ হবেন তা বাল্যকালেই টের পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৩৮ সালের আরো একটি ঘটনায় কিশোর বঙ্গবন্ধুর সাহসী চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। সে বছরের ১৬ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং তাঁর মন্ত্রিসভার বাণিজ্য ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে আসেন। তাঁরা তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল পরিদর্শন করেন। স্কুল প্রাঙ্গণের সভা শেষে তাঁরা গোপালগঞ্জ ডাকবাংলোয় ফিরছিলেন। সঙ্গে ছিলেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। এসময় কিশোর বঙ্গবন্ধু কয়েকজন ছাত্রসাথী নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পথরোধ করে দাঁড়ালেন। বিষয়টা লক্ষ করে, প্রধান শিক্ষক ঘাবড়ে গেলেন, কারণ তারই ছাত্ররা মুখ্যমন্ত্রীর সাথে বেয়াদবি করছে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে মন্ত্রীদের সামনে থেকে সরে যেতে বললেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীরা অনড়, মন্ত্রীদের কাছে তাঁদের দাবি না জানিয়ে তাঁরা পথ ছাড়বেন না। শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুজনেই অবাক চোখে বঙ্গবন্ধুকে দেখলেন। বাংলার এক ব্যাঘ্রপুরুষ সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছিলেন আরেক সম্ভাবনাময় সিংহশাবককে। একটা বিপুল সম্ভাবনা শেরে বাংলা লক্ষ করেছিলেন সেদিন এ কিশোর বালকের চোখে-মুখে।
অবশেষে তিনি জানতে চাইলেন, কী তারা বলতে চায়। অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীদের সামনে এগিয়ে গিয়ে তাঁদের হোস্টেলের ভাঙা ছাদের কথা এবং তা দিয়ে পানি চুইয়ে তাঁদের বই-খাতা ও বিছানাপত্র ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা বললেন এবং এও বললেন, হোস্টেলের ছাদ মেরামতের ব্যবস্থা করে না গেলে তাঁরা পথ ছাড়বেন না। অবশেষে বঙ্গবন্ধুর দাবিমতে হোস্টেলের ছাদ মেরামতের খরচ হিসেবে শেরে বাংলা তাঁর ঐচ্ছিক তহবিল থেকে বারোশো টাকা মঞ্জুর করলেন। ডাকবাংলোয় ফিরে দুই মন্ত্রী এই সাহসী কিশোর সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং পরে সোহরাওয়ার্দী স্লিপ পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ডেকে নিয়ে তাঁর সাথে আলাপ করেছিলেন। বাংলার মহান নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বঙ্গবন্ধুর পরিচয়ের সূত্রপাত এভাবেই হয়েছিল।
১৯৩৮ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে গোপালগঞ্জে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কিছুটা বিরোধের সৃষ্টি হয়। সে সময় মালেক নামে একজনকে হিন্দু মহাসভার লোকেরা ধরে নিয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে সেখানে যান এবং তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মারামারি বেঁধে যায়। রমাপদ দত্তের মাথা ফেটে যায় এবং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীরা দরজা ভেঙে অবরুদ্ধ মালেককে উদ্ধার করে নিয়ে যান। হিন্দু মহাসভার নেতারা এ ঘটনায় থানায় এজাহার করলে পুলিশ পরদিন বঙ্গবন্ধুসহ অনেককে গ্রেফতার করে। কোর্টে জামিন না দেওয়ায় বঙ্গবন্ধুকে সাতদিন হাজতবাস করতে হয়। এটাই বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রথম হাজতবাস। পরে অবশ্য উভয়পক্ষে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়। বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ ও টুঙ্গিপাড়া অঞ্চলের নানা সমস্যার ক্ষেত্রে সাধ্যমত ভূমিকা রাখছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে পত্র যোগাযোগসহ তৎকালীন ছাত্র ও যুব রাজনীতির সাথেও বঙ্গবন্ধু সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। [চলবে]