বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা (পর্ব ১)
বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা (পর্ব ২)
বঙ্গবন্ধু ১৯৪২ সালে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর তিনি কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। কলেজের বেকার হোস্টেলে ২৪নং কক্ষে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। এসময় সোহরাওয়ার্দীর সহকারী হিসেবে বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতাস্থ ফরিদপুরবাসীদের সংগঠন ‘ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
বেকার হোস্টেল বলতে চাকরিহীন বেকার মানুষরাই এখানে থাকেন এমনটি নয়। হোস্টেলের নামই বেকার হোস্টেল। কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানকালে তাঁর বাবা প্রতিমাসে তাঁর জন্য পঁচাত্তর টাকা পাঠাতেন। তখনকার দিনে এই টাকা বঙ্গবন্ধুর একার জন্য অনেক। কিন্তু এ টাকা তিনি শুধু নিজের জন্য ব্যয় করতে না। টুঙ্গিপাড়া, গিমাডাঙ্গার এক সহপাঠী শাহাদাৎ হোসেন বঙ্গবন্ধুর সাথে বেকার হোস্টেলের ২৪নং রুমে থাকতেন। তাঁরা দুজনে সারা মাস চলতেন ঐ টাকায়। কারণ শাহাদাতের ক্ষেতমজুর বাবা তার জন্য তেমন কোনো টাকা পাঠাতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তিনিও মানুষের দুঃখ মোচনে সেবামূলক কাজ করেন। কোলকাতায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবাযত্নে তিনি আত্মনিয়োগ করেন।
রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ছাত্রসংগঠনের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িয়ে পড়েন। মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদে শেষপর্যন্ত তিনি আস্থাশীল হয়ে উঠেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। জ্ঞানার্জনের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ছাত্রজীবনেই বেশ কিছুসংখ্যক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতার সাথে ব্যক্তিগতভাবে মেলামেশার সুযোগ হয়। বঙ্গবন্ধু সিলেবাসের বাইরের বিষয়েও যথেষ্ট পড়াশোনা করেন। তিনি ছাত্রজীবনেই বুঝতে পেরেছিলেন, উপযুক্ত জ্ঞানার্জন ছাড়া কোনো আদর্শকেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু ইতিহাস ও সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন। রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়েও তখনই বেশ কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। পৃথিবীর প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও সমাজতত্ত্ববিদের গ্রন্থপাঠে অভ্যস্ত হন। এসময়েই কার্ল মার্কস, জর্জ বার্নার্ড শ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক মনীষীর ভক্তপাঠক হয়ে ওঠেন। বিএ ক্লাসে বঙ্গবন্ধুর ঐচ্ছিক বিষয় ছিল ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। কারণ তিনি জানতেন রাজনীতি চর্চায় এ দুটি বিষয়ে জ্ঞান থাকা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
কোথায় নেই বঙ্গবন্ধু, যেখানে কোনো সামাজিক কাজ বা কারো উপকারের ডাক পড়ে সেখানেই বঙ্গবন্ধু গিয়ে হাজির হতেন। যেমন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মী ও বন্ধুদের নিয়ে বিপন্ন মানুষদের উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিপদ মাথায় নিয়ে তিনি আটকাপড়া বহু হিন্দু ও মুসলমান পরিবারকে তাদের নিরাপদ এলাকায় পৌঁছে দেন। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত মানুষের খাবার নিশ্চিত করতে গিয়ে তিনি অনেক সময় নিজেই চাউলবোঝাই ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে গিয়েছেন। কলকাতার দাঙ্গা বন্ধ হতে-না-হতেই নোয়াখালী ও বিহারে দাঙ্গা বেঁধে যায়। এতে অনেক লোক মারা যায়, বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। বঙ্গবন্ধু পাটনায় এবং আসানসোল রিফিউজি ক্যাম্পে দেড় মাস ধরে ত্রাণ কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
আসানসোল রিফিউজি ক্যাম্প থেকে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ শরীর নিয়ে কলকাতায় আসেন। বেকার হোস্টেলে এসে তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে ট্রপিক্যাল স্কুল অব মেডিসিনের ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। পনের দিন হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে তিনি হোস্টেলে ফিরে আসেন। এরপর বিএ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি ইসলামিয়া কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ড. জুবেরীর কাছে অনুমতি চাইলে তিনি একটানা কয়েকমাস লেখাপড়া করার শর্তে অনুমতি প্রদান করেন। বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বঙ্গবন্ধু হোস্টেল ছেড়ে বইপত্র নিয়ে হাওড়ার উল্টোডাঙ্গায় শাহাদাতের কাছে চলে যান। এই শাহাদাত একসময় বঙ্গবন্ধুর সাথে বেকার হোস্টেলের ২৪নং কক্ষে থাকতেন। পরীক্ষার আগে আগে বঙ্গবন্ধু পার্ক সার্কাসে তাঁর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবতের বাসায় ওঠেন। ১৯৪৭ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ পাশ করেন।
সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পর বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে প্রথমে টুঙ্গিপাড়া যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তিনি ১৫০ মোগলটুলিতে গণতান্ত্রিক যুবলীগ অফিসের দোতলায় শওকত মিয়ার কক্ষে বসবাস শুরু করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকায় এসেই বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক যুবলীগের সাথে যুক্ত হন। শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, কমরউদ্দিন আহমদ, নইমুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দিন আহমদ এবং অলি আহাদের সাথে এখানেই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়। ঐ সময় পূর্ববাংলায় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের সাথে প্রগতিশীল ছাত্রনেতাদের বিরোধের সূত্রপাত হয়। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তরুণ ছাত্রদের বিদ্রোহী করে তোলে।
দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীগণ তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা চালিয়ে আসছিল। কিন্তু তাদের দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়ায় ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ থেকে তারা ধর্মঘট শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু, দবিরুল ইসলাম, অলি আহাদসহ ছাত্রনেতারা কর্মচারীদের ধর্মঘট সমর্থন করেন। কর্মচারীদের সমর্থনে ছাত্ররাও ধর্মঘট অব্যাহত রাখেন। প্রাদেশিক সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেন চিরাচরিত নেতিবাচক পন্থায়—বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ এবং ২৭ জন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন দণ্ডপ্রাপ্তদের একজন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রস্তাব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু যদি মুচলেকা অর্থাৎ বন্ড সই করেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। মুচলেকা দিয়ে এই শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা বঙ্গবন্ধুর কাছে মর্যাদাপূর্ণ মনে হয়নি।
১৯৪৯ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলে এবং ছাত্ররা বহিষ্কারাদেশের বিরুদ্ধে ১৮ এপ্রিল ছাত্রধর্মঘটের ডাক দেয়। কিন্তু ইতোমধ্যে কিছু ছাত্র বন্ড দিয়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়ায় ছাত্রআন্দোলন কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজন ছাত্র ভাইস চ্যানসেলরের বাসভবনে অবস্থান নেন এবং তাঁরা ঘোষণা করেন, শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাঁরা সেখানেই অবস্থান করবেন। ১৯ এপ্রিল বিকালে ভাইস চ্যান্সেলরের আহ্বানে পুলিশ এসে বঙ্গবন্ধুসহ সেখানে অবস্থানরত ছাত্রদের সকলকে গ্রেফতার করে। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পর দ্বিতীয়বার এভাবে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। [চলবে]