১৯৭৩ সালের জোট নিরপেক্ষ ন্যাম সম্মেলন। ভেন্যু আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স। বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইট থেকে নেমে টারমাকে পা দিলেন বিশাল দেহের এক মানুষ। আর তাকে রিসিভ করতে সব ধরনের প্রটোকল ভেঙে দাঁড়িয়ে আছেন আরেক দেশের এক রাষ্ট্রপ্রধান। কোনো প্রটোকল মানেননি তিনি। স্বাভাবিকভাবে লম্বা মানুষটির জন্য আসার কথা আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। সর্বোচ্চ হলে রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের। কিন্তু এলেন একটি ভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। ভিন্ন দেশের সে রাষ্ট্রপ্রধানের নাম জোসেফ ব্রোজ টিটো। আর লম্বা মানুষটি হলেন একটি ২ বছর বয়সী শিশু রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান—নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনটি দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন টিটো। সমীহ জাগানিয়া সেই বাহিনীগুলো হলো—অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, রাশিয়ান লালফৌজ আর যুগোশ্লাভিয়ান সেনাবাহিনী। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আর উত্থান-পতনের খরস্রোতের ভ্রুকুটি অস্বীকার করে গড়েছেন বিপ্লবী সরকার। পুরো জীবনই পরিচিত ছিলেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। বঙ্গবন্ধু মাটিতে নামতেই তাকে জড়িয়ে ধরলেন টিটো। চোখ অশ্রুসজল। দুটো মানুষ কখনোই একে অপরকে দেখেননি। কিন্তু তারা যেন আত্মার আত্মীয়। পৃথিবীর দুই প্রান্তের, দুই অঞ্চলের, মেরুব্যবধানে অবস্থিত দুই সংস্কৃতির জনমানুষের নেতা তারা। এই মুহূর্তে মুখোমুখি দাঁড়ানো এই দুই রাষ্ট্রপ্রধানের পেছনে পড়ে আছে ভয়াবহ বিরুদ্ধ স্রোত মোকাবেলার দীর্ঘ ইতিহাস। তাই অভিজ্ঞতার এক অভিন্ন ছাঁচে তারা একে অন্যকে চিনে নিতে পারেন, সেই জেনে ওঠা যেন ইতিহাসের নিজস্ব দ্বন্দ্ব—শোষিতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকেও উৎসারিত।
১৯৭৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে বার্তা সংস্থা তাসকে টিটো বলেছিলেন, “আমি শেখ মুজিবকে দেখিনি আগে। তার সঙ্গে আমার যোগসূত্রগুলো ছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, কিছু চিঠিপত্র, লালফাইল বগলে নিয়ে কার্যালয় প্রদক্ষিণ করা আমলার দল আর লাল রঙের একজোড়া টেলিফোন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা আত্মার আত্মীয় ছিলাম। কারণ আমাদের স্বপ্ন ছিল এক। আমরা বৈষম্যহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলাম। ভালোবাসাময় সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলাম। শোষণমুক্ত ব্রহ্মাণ্ডের স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমরা এজন্যই আত্মার আত্মীয়।”
মার্শাল টিটোর একটি বড় দুর্নাম ছিল। তিনি অত্যন্ত কঠোর হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। তাকে অশ্রুসজল অবস্থায় কেউ কখনো দেখেননি। শুধু আলজিয়ার্স আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সেই টারমাক ছাড়া। টিটো সেখানে সেদিন কেঁদেছিলেন। কাছের মানুষকে কাছে পাবার আনন্দের অশ্রু। সেবারের ন্যাম সম্মেলন ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বনেতাদের পরিচিতির সম্মেলন। এই সম্মেলনে একটি দেশের নেতা বঙ্গবন্ধু পা বাড়ালেন আন্তর্জাতিক পরিসরে। তার সঙ্গে সেই সম্মেলনে দেখা হয়েছিল ফিদেল ক্যাস্ট্রো, লি কুয়ান আর গামাল আব্দুল নাসেরের মতো নেতাদের। প্রবল মেরুকরণের যুগে যারা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশকে সেই স্রোতে গা ভাসানো থেকে দূরে রেখেছিলেন। রচনা করছিলেন একের পর এক রাজনৈতিক মহাকাব্য।
জোসেফ মার্শাল টিটো তার আত্মজীবনীতে আমাদের জানাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধুকে তিনি সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, তারা বড় অনেকগুলো দেশের চক্ষুশূল। তাই সাবধানে থাকাই শ্রেয়। বরাবরের মতোই বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে হালকাভাবেই নিয়েছিলেন। জোট নিরপেক্ষ দেশের অধিকাংশ নেতাই একাধিকবার হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হয়েছেন একবার। সে একবারেই তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। কারণ বঙ্গবন্ধু একটিবারের জন্যও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেননি। নিজের দেশের মানুষকে তিলমাত্র অবিশ্বাস করতে চাননি। জোসেফ মার্শাল টিটো নিজেও একাধিকবার হত্যার শিকার হতে পারতেন। সাবধানতা তাকে রক্ষা করেছিল।
ন্যামের জন্ম হয় ১৯৬১ সালে টিটোর নিজ শহর বেলগ্রেডে। টিটোই ছিলেন সংগঠনটির প্রথম সাধারণ সম্পাদক। এই সংস্থা গঠনের পেছনে ছিলেন তিনজন মানুষ। যুগোস্লাভিয়া থেকে টিটো, সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের (মিসর ও সিরিয়া) গামাল আব্দুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার আহমেদ সুকর্ণ, ঘানার কাওয়ামে ক্রুমাহ আর ভারতের জওহরলাল নেহেরু। নেহরু ছিলেন পাঁচশীল নীতির প্রবক্তা। গত শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতি ছিল আপাদমস্তক ঘটনাবহুল। ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ ওই সময়টাতে ঘটে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং আরো বেশকিছু ঘটনা যা ভবিষ্যত বিশ্বের মোড় আমূল ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আর এই পটপরিবর্তনের মধ্যেই ন্যাম অনেক দেশের ঔপনিবেশিক কাঠামো ভাঙতে সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল। এই আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য ছিল ১০টির অধিক দেশের স্বাধীনতা। এবং একইসাথে বিশ্বশান্তি রক্ষায়ও এই আন্দোলনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
১৯৫৫ সালের ১৮-২৪ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বান্দুং এশিয়ান-আফ্রিকান কনফারেন্স। সেই কনফারেন্সে অংশ নিয়েছিলেন ঔপনিবেশিক যুগপরবর্তী ২ মহাদেশের ২৯টি স্বাধীন দেশের নেতারা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা বিবেচনা করে করণীয় ঠিক করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। বান্দুংয়ের এই সভাটি থেকেই ন্যাম গঠনের প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৬০ সালের শুরুর দিকে ন্যাম গঠন আরো একধাপ এগিয়ে যায় জাতিসংঘের ১৫তম সাধারণ অধিবেশনে। সেখানে এশিয়া ও আফ্রিকার নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ১৭টি দেশকে নিয়মিত অধিবেশনে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হয়। এসবের নেপথ্যে কাজ করছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের, যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা জোসেফ ব্রোজ টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, ঘানার কাওয়ামে ক্রুমাহ এবং ইন্দোনেশিয়ার আহমেদ সুকর্ণ। এই পাঁচজন নেতার হাত ধরেই মূলত গড়ে ওঠে ন্যাম। পরবর্তীতে ন্যামকে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর মতো নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত হয় ন্যামের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন। যেখানে অংশ নেয় ২৫টি দেশ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়াতে ন্যামকে কোনো সংগঠনের বদলে একটি আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধরে রাখায় পরস্পরকে সংযোগিতা এবং শক্তিবৃদ্ধি করা, জাতিবিদ্বেষ দূরীকরণ, বৃহৎ শক্তির চাপে পরে বহুপক্ষীয় সামরিক চুক্তি করায় বাধ্য হওয়া থেকে রক্ষা করা, এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের অবরোধ হুমকিকে যৌথভাবে মোকাবেলা করা, এবং এর সাথে জাতিসংঘকে শক্তিশালী করা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা ইত্যাদি ছিল ন্যামের প্রাথমিক লক্ষ্য। তবে ন্যামের সর্বপ্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে আপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী সদস্য দেশগুলোকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখানো, বহির্শক্তির প্রভাব থেকে রক্ষা এবং দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্যদেশের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।
তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাচ্ছিল, তাদের প্রতি প্রথম থেকেই সমর্থন প্রকাশ করে গেছে ন্যাম। পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর অধিকার নিয়েও সবসময় মুখর থেকেছে।
ন্যাম সম্মেলন প্রসঙ্গে ফেরা যাক। সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী একবার নিজের স্মৃতিচারণে জানিয়েছিলেন, সেই সম্মেলনের কথা—“১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে ‘জোটনিরপেক্ষ ৭৩ জাতি শীর্ষ সম্মেলন’ চলছে। বাংলাদেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। একটি স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একজন গণতান্ত্রিক নেতা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন, সেই নেতাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন শীর্ষ সম্মেলনে আগত অন্যান্য নেতারা।
বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কক্ষে ঢুকতেই অনেক নেতা তার দিকে ছুটে আসেন। আমার সাংবাদিক জীবনের এটা সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। সম্মেলনের তখন চা-বিরতি হয়েছে। রাষ্ট্রনায়করা একটা বিরাট হল ঘরে পানীয় হাতে পরস্পরের সঙ্গে গল্প করছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে তাদের কয়েকজন গোল হয়ে দাঁড়ালেন। ভারতের ইন্দিরা গান্ধী এগিয়ে এসে সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মিসরের আনোয়ার সাদাত, লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফি, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো ও কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো এবং এ বৃত্তের বাইরে, একটু বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন সৌদি আরবের বাদশা ফয়সাল। সম্ভবত আরো দুয়েকজন ছিলেন। তাদের কথা মনে নেই।”
বঙ্গবন্ধুকে কোনো আঞ্চলিক রাজনীতিবীদ হিসেবে দেখার কখনোই সুযোগ নেই, কখনো ছিলও না। বঙ্গবন্ধু সেই নেতাদের অংশ ছিলেন, যারা পিছিয়ে পড়া একাধিক দেশের সাধারণ মানুষের স্বপ্ন দেখানোর কারিগর। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সামনের সারিতে যেসব নেতারা ছিলেন, টিটো বাদে কারোরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। সবার মৃত্যু হয়ছে ষড়যন্ত্রের জালে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে। ওই বছরেরই জুলাই মাসে হত্যা করা হয় সৌদি আরবের বাদশা ফয়সালকে। তিনি এক বছরের মধ্যে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের দখলমুক্ত করে পবিত্র আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। তিনি তার পরিবারের এক সদস্যের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন।
ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করেছে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করে চরমপন্থি মুসলিম ব্রাদারহুডের জঙ্গিরা। যদিও বলা হয়, ইয়াসির আরাফাত রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এখন জানা যাচ্ছে, মোসাদের চরেরা তার শরীরে স্লো পয়জনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। আরব বসন্তের নামে হত্যা করা হয় লিবিয়ার গাদ্দাফিকে।
টিটোর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন সারথিদের সর্বাগ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধুই। তাকেই হত্যা করা হয় সবার আগে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতারা সারাবিশ্বের জন্যই আলোকবর্তীকার মতো। যারা বিশ্বকে শেকলবন্দী করে রাখতে চায়, বঙ্গবন্ধু তাদের জন্য ছিলেন পথের কাঁটা।