ঊর্দু বিভাগ আছে জানেন না কেউ, খবর রাখেন শুধু শিক্ষকেরা!

, ক্যাম্পাস

তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো | 2024-02-29 21:03:12

‘ঊর্দু বিভাগটা কোনদিকে জানেন নাকি’, এমন প্রশ্নে চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম যেন আকাশ থেকে পড়লেন। অনেকটা নিশ্চিত হয়েই বললেন, ‘আমাদের কলেজে তো ঊর্দু বিভাগই নেই।’

পরে কলেজের প্রশাসনিক দপ্তরে গিয়ে ভুল ভাঙার পর মাহমুদুলের চোখে-মুখে অপার বিস্ময়! বললেন, ‘এত বছর ধরে কলেজে পড়ছি। পুরো ক্যাম্পাস আমার নখদর্পণে। কিন্তু কোনোদিন তো শুনিনি ঊর্দু বিভাগের কথা’!

এই বিস্ময় শুধু মাহমুদুল করিমের একার নয়, বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়, এই প্রতিবেদকের। তাদের কেউ জানেন না, কলেজে ঊর্দু বিভাগ নামে কোনো বিভাগ আছে। বললেন, এই প্রথম ঊর্দু বিভাগের বিষয়ে জানলেন।

চট্টগ্রাম তো বটেই, দেশের সবচেয়ে পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম- চট্টগ্রাম কলেজ। ১৮৩৬ সালে চট্টগ্রাম জেলা স্কুল হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। প্রতিষ্ঠালগ্নের ৩৩ বছর পর ১৮৬৯ সালে একে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়। তখন থেকেই এটি- চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ বা চট্টগ্রাম কলেজ নামে পরিচিত হয়। কলেজে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাশাপাশি এখন মানবিক ও বিজ্ঞান বিষয়ে ২০টি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে।

তবে কবে এই কলেজে ঊর্দু বিভাগ সংযুক্ত করা হয়েছে, সেটি কেউ বলতে পারেননি। আর সর্বশেষ কবে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন, সে সম্পর্কেও কারো কোনো ধারণা নেই। কেউ বলেছেন ৪০ বছর আগে সর্বশেষ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। কেউবা আবার বলেছেন, স্বাধীনতার পর এই বিভাগে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হননি।

কলেজের ওয়েবসাইটেও সে বিষয়ে কোনো কিছুই উল্লেখ নেই। কোনো নথিপত্রেও এই বিভাগের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু লেখা নেই। প্রখ্যাত ঊর্দু কবি ও পণ্ডিত সৈয়দ ইকবাল আযম এই বিভাগের একসময় প্রধান ছিলেন। বর্তমানে কোনো শিক্ষক-ছাত্র না থাকলেও কাগজে-কলমে থাকা ঊর্দু বিভাগের নামে দুটি পদ (সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক) বরাদ্দ আছে।

খবর রাখেন শিক্ষকেরা
কলেজে ঊর্দু বিভাগ আছে, সেটি শিক্ষার্থীদের অজানা হলেও ঠিকই খবর রাখেন শিক্ষকেরা। কেননা, এই বিভাগের অধীনে থাকা দুটি পদকে কাজে লাগান তারা। বিভাগের নামে কোনো কক্ষ, সাইনবোর্ড না থাকলেও নিয়মিতই দুই পদের অধীনে শিক্ষক পদায়ন হচ্ছে। যদিও ওই শিক্ষকেরা কেউ ঊর্দু বিভাগের শিক্ষক নন।

মূলত বিভাগটিতে শিক্ষকদের শূন্যপদের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন কলেজের অন্য বিভাগের শিক্ষকেরা বদলি হয়ে আসেন চট্টগ্রামের এই শীর্ষ কলেজে। পরবর্তীতে নিজস্ব বিভাগে শিক্ষক পদ শূন্য হলে সেখানে চলে যান। সর্বশেষ, সহকারী অধ্যাপক পদে ঊর্দু বিভাগে যোগ দেন ড. মোহাম্মদ আরিফুল হক। পরবর্তীতে তিনি নিজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে চলে যান। অবশ্য তিনি এখন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বদলি হয়েছেন। একইভাবে প্রভাষক পদে যোগ দেন মিজানুর রহমান। কিছুদিন পর নিজের পরিসংখ্যান বিভাগে পদ শূন্য হলে তিনিও সেখানে চলে যান। এখন ঊর্দু বিভাগের দুটি পদই শূন্য আছে।

কলেজের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম কলেজ বৃহত্তর চট্টগ্রামের একটি শীর্ষ কলেজ। স্বাভাবিকভাবেই এই কলেজে যোগদান করতে শিক্ষকদের একটা বাড়তি আগ্রহ থাকে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী, পদ তো কম। সেজন্য ঊর্দু বিভাগের শূন্যপদ দুটিতে অনেকেই পদায়নের চেষ্টা করেন। আর এক্ষেত্রে যেহেতু বাধা নেই, অনেকে এই বিভাগের শূন্যপদে যোগদান করেন। তবে ক্লাস নেন নিজের বিভাগে। আর পদ শূন্য হলেই নিজের বিভাগের অধীনে চলে যান তারা।’



কলেজের প্রধান অফিস সহকারী গোলাম কিবরিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিভাগের অধীনে দুটি পদ আছে। এই পদের বিপরীতে অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকেরা যোগদান করেন। তবে বর্তমানে পদ দুটি শূন্য রয়েছে। কয়েকদিন আগেও মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে পদ শূন্য থাকার কারণ জানতে চেয়েছে।’

শিক্ষার্থী না-থাকলেও শিক্ষকদের জন্য কেন পদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, এমন প্রশ্নে গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘এই বিভাগে সর্বশেষ কখন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন, তা কেউই জানেন না। এই বিষয়ে কোনো নথিও নেই। আমরাও শিক্ষার্থী ভর্তি না হওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। শিক্ষকদের পদ রাখার বিষয়টি তাই মন্ত্রণালয়ের বিষয়। আমরাও ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের ঊর্দুর বিষয়ে কোনো কিছু বলি না। কাউকে এই বিভাগে ভর্তির বিষয়েও উৎসাহিত করি না। কারণ, এই বিষয়ের শিক্ষকই নেই। শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে কী করবেন এখানে’।

শিক্ষার্থীদের আগ্রহ না থাকলে ঊর্দু বিভাগ রাখার বিষয়ে পক্ষপাতী নন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডার মোজাফফর আহমদ। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছিলাম। তবে সব ভাষাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন্তু যে ভাষা শেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ নেই বহু বছর, সেই বিষয়ে কেন একটা বিভাগ থাকবে’!

এ সম্পর্কিত আরও খবর