‘শুভ জন্মদিন হে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’

বিবিধ, ক্যাম্পাস

রুদ্র আজাদ, জাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা ২৪.কম | 2023-08-28 15:36:45

সবুজ বৃক্ষ, বহমান লেক আর ষড় ঋতুর বিষ্ময়পুত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ছাতিমের সৌরভ আর কৃষ্ণচূড়ার লাল এ ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি। সেই হিসেবে শনিবার (১২ জানুয়ারি) এ বিশ্ববিদ্যালয়টি তার প্রতিষ্ঠার ৪৮টি বছর অতিক্রম করে ফেলেছে।

জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেখেছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন এই ভূমির শিক্ষার্থীরা। এরশাদ সরকারের আমলে শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনেও শিক্ষার্থীরা সামনে থেকে আন্দোলন করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা মানিক ও তার সঙ্গীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে টিকে থাকতে পারেনি এই ক্যাম্পাসে। এই আন্দোলন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন বলেও বেশ পরিচিত।

১৯৬৪ সালের তৎকালীন পাকিস্তান সরকার একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তার ফলশ্রুতিতে ১৯৬৫ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যকরী সংসদ এরূপ একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সেই সময়ে ঢাকার কাছাকাছি কোন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে গাজীপুরের সালনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্থান নির্ধারণ করে আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়ে ১৯৬৭ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পশ্চিম পাশে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়।

প্রতিষ্ঠার সময়কালীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৭৫০ একর জমি বরাদ্দ থাকলেও আশির দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে ৫০ একর ছেড়ে দিতে হয় ফলে এর পরিমাণ এসে দাঁড়ায় ৬৯৭.৫৬ একর।

ঢাকা শহরের মুঘল আমলের নাম ‘জাহাঙ্গীরনগর’ থেকেই ১৯৭০ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে মুসলিম শব্দটি কেটে এর নাম রাখা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি স্নাতক পর্যায়ে প্রথম ক্লাস শুরু হলেও ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রিয়ার এডমিরাল এস.এম আহসান।

১৯৭০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হন অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, যিনি বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে ২০১৪ সালের ২ মার্চ থেকে দায়িত্ত্বরত আছেন (২য় মেয়াদ সহ)।

বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথমে মাত্র ৪টি বিভাগ ২১ জন শিক্ষক আর ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের পরিবর্তনে এখন ৬টি অনুষদের অধীনে ৩৪টি বিভাগ ও ৩ টি ইন্সটিটিউটে মোট সাতশ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার শিক্ষার্থী এখানে অধ্যায়ন করছেন। ছেলে-মেয়েদের জন্য সমান ৮টি করে মোট ১৬ টি আবাসিক হল রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দেশের প্রথম প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ স্থাপিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিভাগের অধীনে উয়ারী বটেশ্বরে খননকার্য চালানো হয়। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’।

সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী নামেও পরিচিত। বছরব্যাপী নাটক, বিতর্ক, আবৃত্তি, নৃত্য, সংগীতানুষ্ঠানসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখরিত থাকে ‘সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ’। বিকেলে মুক্তমঞ্চ, খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া চত্বর, টারজান পয়েন্ট, শহীদ মিনার, অমর একুশের পাদদেশসহ প্রভৃতি স্থানে জমে উঠে আড্ডা ও গানের আসর চলতে থাকে কোরাসের পর কোরাস।

দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এই বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য জ্ঞানী মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছে। যাদের মধ্যে রয়েছে প্রখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরুল ইসলাম, লেখক হুমায়ুন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক।

এছাড়াও অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আনু মুহাম্মদ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান, রসায়নবিদ অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, ইতিহাসবিদ এ কে এম শাহনাওয়াজ প্রমুখ।

এছাড়া সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অঙ্গনে রয়েছে সরব পদচারণ বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য মুশফিকুর রহিম, মাশরাফি বিন মর্তুজা যার অন্যতম উদাহরণ। এছাড়াও অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদি, শহীদুজ্জামান সেলিম, ফারুক আহমেদ, শুভাশীষ ভৌমিক, জাকিয়া বারি মম, বিদ্যা সিনহা মীম, সুমাইয়া শিমু প্রমুখ।

বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘অমর একুশে’ ভাস্কর্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে হাত-পা হারানো দেশের বীর সন্তানদের শ্রদ্ধায় নির্মাণ করা হয়েছে স্মারক ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’।

প্রকৃতির এ স্বর্গে রয়েছে কয়েকটি স্বচ্ছ পানির লেক। শীতের মৌসুমে এখানে প্রচুর অতিথি পাখি আসে। অতিথি পাখিদের শুভেচ্ছা জানাতে লেকগুলোতে ফুটে ওঠে হাজারও লাল শাপলা। তারই মধ্যে পাখিদের উড়াউড়ি আর জলকলির দৃশ্য মুগ্ধ করে দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের। তাছাড়া ষড় ঋতুর পরিবর্তনে ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সকলকে আকৃষ্ট করে। প্রজাপতির সংরক্ষণ ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ‘প্রজাপতি পার্ক’।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতার পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা। পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হওয়া সত্ত্বেও হলগুলোতে রয়েছে তীব্র সিট সঙ্কট। এর ফলে ‘নিকৃষ্ট গণরুম সংস্কৃতি’ থেকে বের হতে পারছে না হলগুলো।

এদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের তালে এগিয়ে যাচ্ছে তখনও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে আছে প্রাচীন চিন্তা-ধারণা নিয়ে। লাইব্রেরী থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীর পরীক্ষাপদ্ধতি, রেজাল্ট তৈরি করার সিস্টেম গুলো আজও সনাতন পদ্ধতিতে হচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভুগতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের।

এছাড়াও দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (জাকসু) নির্বাচন। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবীগুলো অব্যক্ত থেকে যাচ্ছে। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে এখানকার উপাচার্যরা নিজেদের প্রভুর আসনে বসিয়ে স্বার্থের অনুকূলে থাকা সব মহাযজ্ঞ সাধন করতে সর্বদা তৎপর থাকেন। আর এসব মহাযজ্ঞের অন্তরালে ঢাকা পড়ে যায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া পাওয়া গুলো। তবে সব সীমাবদ্ধতার বাইরে গিয়ে সবুজ গালিচা বিছানো পথের মতো আর সুউচ্চ শহীদ মিনারের মত বাংলাদেশ ও বিশ্বের মাঝে মাথা উঁচু করে আরও হাজার বছর বেঁচে থাক ‘প্রাণের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’।

 

১২.০১.১৯

এ সম্পর্কিত আরও খবর