সারা দেশব্যাপী সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের, শিক্ষক ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের এ ত্রিমুখী আন্দোলনে থমকে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)।
১ পহেলা জুলাই থেকেই থমকে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম। একদিকে, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা 'প্রত্যয় স্কিম’ প্রত্যাহারসহ তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালন, অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে জুন মাসের প্রথম দিকেই আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষকদের আন্দোলন
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃক জারিকৃত সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয় স্কিম’ প্রত্যাহার করা এবং আগের পেনশন স্কিম চালু রাখার দাবিতে চলতি বছরের ২০ মে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন।
তারই ধারাবাহিকতায় ২৬ মে সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) সারাদেশের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে মানববন্ধন করেন শিক্ষকরা।
২৮ মে দুই ঘণ্টা এবং ২৫-২৭ জুন তিনদিন সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন তারা।
এরপর ৩০ জুন পূর্ণ কর্মবিরতি পালন করা হয় এবং ১ জুলাই থেকে থেকে সারাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো.আখতারুল ইসলাম ও মহাসচিব এবং ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ কর্মবিরতির ঘোষণা করা হয়।
৩০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে জানানো হয়, এ আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলন। বৈষম্যমূলক ও মর্যাদাহানিকর ‘প্রত্যয় স্কিম’ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনস্কেল প্রবর্তন, প্রতিশ্রুত সুপারগ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হবে।
কর্মসূচি ঘোষণা
বিবৃতিতে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ৯টি কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এগুলোর মধ্যে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের সব ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে; অনলাইন, সান্ধ্যকালীন ক্লাস, শুক্র ও শনিবারের প্রফেশনাল কোর্সের ক্লাস বন্ধ থাকবে; সব পরীক্ষা বর্জন করা হবে। মিডটার্ম, ফাইনাল ও ভর্তি পরীক্ষাসহ কোনো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না।
বিভাগীয় চেয়ারম্যান বিভাগীয় অফিস, সেমিনার, কম্পিউটার ল্যাব ও গবেষণাগার বন্ধ রাখবেন।
একাডেমিক কমিটি, সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটি, প্রশ্নপত্র সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হবে না; অনুষদের ডিনবৃন্দ ডিন অফিস, ভর্তি পরীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট কর্যক্রম বন্ধ রাখবেন।
নবীনবরণ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গ্রহণ করা যাবে না। কোনো সিলেকশন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে না।
বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালকবৃন্দ ইনস্টিটিউটের অফিস, ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখবেন। সান্ধ্যকালীন, শুক্রবার ও শনিবারের ক্লাস বন্ধ থাকবে; বিভিন্ন গবেষণাধর্মী সেন্টারের পরিচালকরা কোনো সেমিনার, কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপের কর্মসূচি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেন; বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষগণ প্রাধ্যক্ষ অফিস বন্ধ রাখবেন; প্রধান গ্রন্থাগারিক কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি বন্ধ রাখবেন।
১ জুলাই থেকে থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু হয়ে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) ৭ম দিনের মতো চলছে শিক্ষক ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মবিরতি।
শিক্ষক সমিতির বক্তব্য
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব এবং শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কারা আমাদের আন্দোলনে নামিয়েছে! আমরা মনে করি, তারা রাষ্ট্রের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা লোক; যারা ২০১৫ সালেও আমাদের বিরুদ্ধে লেগেছিল। সে বছর তারা আমাদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। তাই, এ বছরও তারা আমাদের পেছনে লেগেছে। তারা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই একটি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। এটা সম্পূর্ণ অন্যায় ও অন্যায্য।
আন্দোলন সফল হওয়ার আগে অব্দি ক্লাসে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, এ নিয়ে শিক্ষক প্রতিনিধিরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা বলেছিলাম, এই স্কিম বাতিল করুন, না-হলে আমরা কর্মবিরতি শুরু করবো। কিন্তু তারা দাবি মানেননি। ফলে, আমরা অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেছি। পরে পূর্ণ দিবস করেছি। এরপর আমরা এই সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছি। যেহেতু, আমরা এই আন্দোলন শুরু করেছি, সফলতা আসার আগে ক্লাসে ফিরবো না।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
পবিত্র ঈদুল আজহার আগে ৫ জুন সরকারি দফতর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন উচ্চ আদালত।
ওই দিন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এ নামেন।
এ অবস্থায় আদালতের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আবেদনটির ওপর শুনানির জন্য ৪ জুলাই দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং শুনানিতে হাইকোর্টের রায় পুনর্বহাল থাকায় আশার আলো দেখতে না পেয়ে দিন দিন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বেগ যেন বেড়েই চলে। বিক্ষোভ মিছিল, অর্ধবেলা-পূর্ণবেলা অবরোধ, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, অনলাইন ও অফলাইনে জনসংযোগ, বাংলা ব্লকেডসহ নানানরকম কর্মসূচি ইতোমধ্যে পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারও শিক্ষার্থী।
মঙ্গলবারের কর্মসূচি
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) চলছে, শিক্ষার্থীদের সারাদেশব্যাপী অনলাইন ও অফলাইনে জনসংযোগ। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার আমাদের যত শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রয়েছেন, তাদের সাথে গণসংযোগ করবো।
এছাড়া বিকেলে একটি প্রেস ব্রিফিং করে বুধবারের কর্মসূচি জানিয়ে দেওয়া হবে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই যে অর্ধবেলা করে অবরোধ দিচ্ছি, এখানেই আমরা থেমে থাকবো না।
আমরা সর্বাত্মক ব্লকেডের পরিকল্পনা করছি। বুধবার আমাদের চলমান কর্মসূচি ছাত্র ধর্মঘট ও ক্লাস পরীক্ষা বর্জন চলবে। আমরা ব্লকেড উইথ্রো (প্রত্যাহার) করিনি। সর্বাত্মক ব্লকেডের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন
শিক্ষকদের মতো অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত পেনশন 'প্রত্যয় স্কিম' সংক্রান্ত ‘বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন’ বাতিলের দাবিতে সর্বাত্মক পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন, কর্মচারী সমিতি, কারিগরি কর্মচারী সমিতি ও চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ’ যৌথভাবে এ কর্মসূচির আয়োজন করে।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা নিয়মিতই রোজ সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান গ্রহণ, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সমাবেশ করে থাকেন।
মঙ্গলবারের কর্মসূচি
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) সপ্তমদিনের মতো চলছে, তাদের কর্মবিরতি। কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোতালেব বলেন, আমরা মঙ্গলবার সকাল থেকে কর্মসূচি শুরু করেছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাবো।
কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানান, এ প্রজ্ঞাপন সব শ্রেণির কর্মচারীর মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে, তা সবকিছুকে খুব খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে। এমন একটি বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন জারির ফলে সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মধ্যে যে চরম হতাশা ও অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়েছে, তা কেবল আমাদের যৌক্তিক দাবি তথা প্রত্যয় স্কিম বাতিলের মধ্যে দিয়েই নিরসন সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে অবিলম্বে আমাদের দাবি মেনে নিয়ে প্রত্যয় স্কিম বাতিল করতে হবে।
ঐক্য পরিষদের নেতারা আরো বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের দাবি বাস্তবায়ন না হয়, ততদিন পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাবো না।অনেকেই বলছেন, অনেক অফিসে জোর করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আটকে রাখা হচ্ছে। আমরা এই বিষয়টির তীব্র নিন্দা জানাই। সংশ্লিষ্টদের বলতে চাই, আমরা আজ যেমন পেটের তাগিদে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি, আপনাদেরও দায়িত্ব রয়েছে, এই প্রত্যয় স্কিম বাদ দেওয়ার দাবিতে একাত্ম হওয়ার।
আমাদের এ আন্দোলন পেটের তাগিদে আন্দোলন। এই প্রত্যয় স্কিম আপনাদেরও ছাড় দেবে না।
বিপাকে শিক্ষার্থীরা
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং শিক্ষক ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতি পালনে এ ত্রিমুখী আন্দোলনের প্রভাবে বিপাকে আছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিম খান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমার খুবই জরুরি একটি কাজে সার্টিফিকেট তোলা লাগবে রেজিস্টার বিল্ডিং থেকে। কিন্তু কর্মচারীদের কর্মবিরতির জন্যে সার্টিফিকেট তোলা সম্ভব হচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাদেকুল ইসলাম সানী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি বন্ধ থাকাতে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। ক্লাস দেরিতে শুরু হবে তাতেও পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটবে। তবে আপাতত সমস্যা হলেও আন্দোলনের ফলে স্থায়ী সমাধান বের হয়ে আসবে, এটাই আশা রাখি।