দেশব্যাপী অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষী আচরণের বিষয়ে সরকারের নীতিকে 'অস্পষ্টতা' উল্লেখ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে খোলা চিঠি দেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
প্রধান উপদেষ্টাকে দেয়া এ চিঠির অনুলিপি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, ধর্ম উপদেষ্টা ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাকেও দেয়া হবে বলে জানান তারা।
শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ খোলাচিঠি পাঠ করা হয়। শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে চিঠিটি পাঠ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন।
এ সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী।
খোলাচিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন গোষ্ঠী, শ্রেণি ও পেশাজীবীর স্বাধীনতা পাবার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে আপনারা বিশাল এক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দেশের হাল ধরেছেন। আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা ও বিগত বছরগুলোতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণের কারণে আপনাদের পথ দুর্গম সেটা আমরা জানি। স্বাধীনতাকামী সকলের ধৈর্য প্রয়োজন সে কথাও আমরা মনে রাখি।
প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়্যের শিক্ষকদের এ মোর্চা নিজেদের পরিচয় জানিয়ে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক (ইউটিএন) সম্বন্ধে আপনি ওয়াকিবহাল নাও থাকতে পারেন। গত এক দশক ধরে এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ লাগাতার নানা অন্যায়, নিপীড়ন ও কর্তৃত্ববাদিতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে আসছেন। তবে আমরা বিশেষ কোনো মার্কার সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে ছিলাম না, এখনও নাই; আমরা গণতন্ত্র ও ন্যায্যতার জন্য হাজির আছি। সেই সূত্রেই জুলাই অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে শিক্ষার্থীদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে এই নেটওয়ার্কের শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থী-জনতার সুহৃদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
পরিতাপের বিষয়, অভ্যুত্থানের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক ও নৈরাজ্যবাদী জমায়েত আমরা লক্ষ করছি। সেসব জমায়েত থেকে অপছন্দের গোষ্ঠী ও দলের বিরুদ্ধে কেবল হিংসাত্মক কথাবার্তাই বলা হচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে সেসব মানুষের ওপর হামলাও চালানো হচ্ছে। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘবদ্ধ হিংস্রতায় নিহত হয়েছেন তিনজন মানুষ। অপরাধীদের ধরতে গিয়ে একজন সেনা কর্মকর্তা হামলায় নিহত হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকে।
রাস্তায় ও পর্যটন অঞ্চলে নারীদের ওপর হামলা, নিগ্রহ এবং চরম হেনস্তা করা হয়েছে। শ্রমিকদের নিগৃহীত করেছেন মালিকপক্ষের গুণ্ডারা। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও দপ্তরে ছোট ছোট অজস্র হিংস্রতার ঘটনা ঘটেই চলেছে। মাজার, মন্দির, শিল্প- স্থাপনা ভাঙচুর থেকে শুরু করে বাউল ও আহমেদিয়াদের ওপরও আক্রমণ হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা দীর্ঘদিন সমাজের মধ্যকার নানাবিধ অমীমাংসা ও গণতন্ত্রহীনতার সাথে সম্পর্কিত বলে আমরা মনে করি। এভাবে চলতে থাকলে নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধের অভাব তীব্রতর হবে এবং সংকট উত্তরণে সরকারকে আরও বেগ পেতে হবে।
অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন আরও বলেন, এই ক্রান্তিকালে বর্তমান সরকারের নির্মোহ ভূমিকা পালন ও আশু পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কাজেই, অতি উৎসাহী গোষ্ঠীগুলোর অসহিষ্ণুতা প্রশমণের জন্য যারা এসব ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচার করছেন এবং বিভিন্ন পরিচয় ও সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর বা নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছেন তাদের থামাতে হবে। তা না করে সরকার বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেরাই যদি এসব হস্তক্ষেপকারীদের সাহস যুগিয়ে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার ভয় দেখিয়ে কোনো গোষ্ঠীর কথা পালনে বাধ্য করেন, যেমনটা ঘটেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সেখানে চাপে পড়ে প্রশাসন নিরাপত্তা দিতে রাজি হয়নি বলে একটি আলোচনা সভা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে শিক্ষার্থীরা) তাহলে আর এত দামে কেনা জুলাই অভ্যুত্থানের কোন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা হলো?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের 'অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ'কে প্রশ্ন করে বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসতে হবে যে তারা আসলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ কীভাবে নিশ্চিত করবেন এবং অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে তাদের অবস্থান তাদের নীতিসমূহের মাধ্যমে কী করে স্পষ্ট করবেন। সহিংস জমায়েতের সংঘবদ্ধ হিংস্রতা থেকে ভিন্ন মত বা সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার রক্ষায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবেন তা সুস্পষ্ট করতে হবে।