ঢাবির হলে নতুনদের জন্য ‘বড় ভাই’দের অলিখিত যত আইন

, ক্যাম্পাস

ইমরান হোসাইন, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 12:36:01

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে তথাকথিত রাজনৈতিক `বড় ভাই’দের বিরুদ্ধে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন অলিখিত আইন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার এসব আইন না মানলে গভীর রাতে গেস্ট রুম বা হলের নির্দিষ্ট রুমে ডেকে নিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে কঠোর শাস্তিও দেওয়া হয়।

এসব আইনের মধ্যে রয়েছে- ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকে সালাম দেওয়া, থ্রি কোয়ার্টার-ট্রাউজার বা লুঙ্গি না পরা, টিভিরুমের সামনের সারিতে না বসা, রিমোট না ধরা, নিজ হলের ক্যান্টিনে না খাওয়া, নিজের পছন্দের রুমে না থাকা, রাতে ক্যাম্পাসে ঘুরাঘুরি করা, ক্লাসে না গেলেও রাজনীতি করা, প্রতিদিন রাতে গেস্ট রুমে হাজিরা দেওয়া ইত্যাদি।

অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক বড় ভাইদের মৌখিক নির্দেশনায় করা এসব অলিখিত আইন না মানলে রাতে গেস্টরুম বা পদধারী নেতাদের দখল করা রুমে নিয়ে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়া হয়। এমনকি অনেককে হলই ছেড়ে দিতে হয়।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর হল ও ক্যাম্পাসের তথাকথিত নিয়মে আটকে যায় অনেকে। গণরুম, গেস্টরুম থেকে শুরু করে নিজের খাওয়া, ঘুম, ফেসবুক স্ট্যাটাস, ভ্রমণ, পড়াশোনা, ক্লাসে উপস্থিতি সবই নির্ভর করে রাজনৈতিক ভাইদের মর্জির উপর।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন হলের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘রাতে কখন ঘুমাব, কোথায় খাব, আগামী দিন ক্লাসে যাবো কি-না, বাড়িতে বেড়াতে যাব কি-না, কেমন পোশাক পরব, ফেসবুকে কী পোস্ট দিলাম, টিভিরুমে সামনে বসব নাকি পিছনে, লিফটে উঠব কি-না, লুঙ্গি-ট্রাউজার বা থ্রি-কোয়ার্টার পরব কিনা- সবকিছুতে নিয়ম মানতে হয়। আর অমান্য করলে শাস্তি পেতে হয়।

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘একদিন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। পরে সেটার জন্য হঠাৎ বড় ভাইয়েরা খবর দিয়ে রুমে ডেকে নিলেন। এক পর্যায়ে তারা বিভিন্নভাবে আমাকে মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া শুরু করেন। কয়েকজন আমাকে মারতেও আসেন।’

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আরবি বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রাতের যেকোনো সময় আমাদের ডাক পড়তে পারে। একদিন একটা ঝামেলা হয়েছিল হলে। দেখি রাত ২টার দিকে বড় ভাইয়েরা (দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা) আমাদের ঘুম থেকে ডেকে হল গেটে নিয়ে যান। সেখানে এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর আমাদের চলে যেতে বলেন।’

এদিকে, অনেক শিক্ষার্থী হলের ‘বড় ভাই‘দের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হলই ছেড়ে দেন। স্যার এএফ রহমান হলের শিক্ষার্থী তানভীর হাসান বলেন, ‘হলে কিছুদিন ছিলাম। এখন বাহিরে থাকি। অনেক কষ্ট হয়, কিন্তু কী করার। হলের এসব নির্যাতন আর সহ্য হচ্ছে না। এজন্য কষ্ট হলেও ভালো আছি কারণ এখানে কারও গালি শুনতে হচ্ছে না।’

সূর্য সেন হলের শিক্ষার্থী রাকিব (স্বাস্থ্য অর্থনীতি, তৃতীয় বর্ষ), ‘বড় ভাই’দের একজন, দাবি করেন, ‘এসব হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যূনতম ম্যানার। এটা উঠে গেলে জুনিয়ররা কিছুই শিখতে পারবে না। ক্যাম্পাসে চলার জন্য এটা অবশ্যই দরকার।’

এদিকে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হল সংসদের (মাস্টারদা সূর্যসেন হলের) এক নেতা বলেন, ‘আসলে আমাদের দলীয় বিভিন্ন প্রোগ্রাম পালন করতে হয়। সেজন্য এগুলো চালু না রাখলে পোলাপান প্রোগ্রামেই আসে না। সে কারণে চালু রাখতে হয়।’ তবে গেস্টরুমে ‘বড় ভাই’রা নতুনদের ভালো মন্দের খোঁজ খবর নেন এবং মানসিকভাবে কোনো ধরণের প্রেশার দেন না বলে তিনি দাবি করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির কারণে হলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরণের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় হলগুলো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতাদের কাছে অলিখিতভাবে ইজারা দেওয়া হয়েছে। কারণ এই গেস্টরুম-গণরুমের সংস্কৃতি টিকে না থাকলে, তাদের রাজনীতিও টিকবে না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘এ ধরণের কোনো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাটা অবশ্যই দৃষ্টিকটু। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা সেটা ক্ষতিয়ে দেখার চেষ্টা করি। প্রমাণিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসবে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর