১৯৬৯ সাল, পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন চলছিল পূর্ব পাকিস্তানে। এ আন্দোলনের ঝড় উঠছিল রাজশাহীতেও। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে কারফিউ ছিল। কিন্তু প্রতিবাদী জনতা ও ছাত্রসমাজ কারফিউ ভেঙে নেমে পড়ে রাজপথে। ড. শামসুজ্জোহা তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রক্টর। শহরে আন্দোলনে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র সামরিক সেনাদের হাতে আহত হয়েছে। সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন বাংলা বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মযহারুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ড. জোহা। আহত ছাত্রদের অবস্থা দেখে মর্মাহত শিক্ষক পরমস্নেহে কোলে তুলে নিয়ে তাদের ভর্তি করেন রাজশাহী মেডিকেলে। ছাত্রদের গায়ের রক্তে ভিজে যায় ড. জোহার পরিহিত শার্ট।
পরের দিন ১৮ই ফেব্রুয়ারি। প্রতিদিনের মতো ড. জোহা বিবিসি ও আকাশবাণীর অনুষ্ঠান শুনছিলেন। ঠিক এই সময়ে বেজে উঠল টেলিফোন। ফোনে একটি সংবাদ পেয়ে সরাসরি চলে গিয়েছিলেন উপাচার্যের ভবনে। ততক্ষণে ছাত্ররা কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নামতে ছিল। নিষেধ অমান্য করে ছাত্ররা ঢাকা-নাটোর মহাসড়কে উঠে যায়। রাস্তায় তখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোন সময়ে যেকোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এই ভয়ে ড. জোহা ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হন। এরই মধ্যে আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষক সেখানে চলে আসেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড. মযহারুল ইসলাম, ড. আব্দুল খালেক, ড. সুব্রত মজুমদার ও ড. মোল্লা। তখন শিক্ষকরা আসামির মতো হাত উপরে করে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন মিস্টার হাদিকে অনুরোধ করেছিলেন ‘দয়া করে গুলি চালাবেন না, আমাদের ছাত্রদের আমরা শান্ত করার চেষ্টা করছি। আমরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছি।’ অনুরোধের মুখে একদিক দিয়ে ড. জোহা গেটের বাইরে গিয়ে ক্যাপ্টেন হাদির সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। অবস্থা আরও খারাপের দিকে গড়াতে পারে ভেবে ড. মযহারুল ড. জোহার পক্ষে ক্যাপ্টেন হাদির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। এরপর তাকে ও অন্যান্য ছাত্রদের নিয়ে ড. মযহারুল ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করেন।
প্রক্টর নিতে এসেছেন, তার সম্মানার্থে অনেক ছাত্র ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদী আরও কিছু ছাত্র দেয়াল টপকে পার হয়ে যায়। ড. জোহা ও অন্যান্যরা দ্বিতীয়বারের মতো ছাত্রদের ভেতরে নিয়ে আসার জন্য মেইন গেটের বাইরে যান। তখন পাকিস্তানি সামরিক সেনাদের প্রতি ড. জোহার অনুরোধ ছিল প্লিজ ডোন্ট ফায়ার। এরপর আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়, সেই গুলি কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে আমার বুকে বিঁধবে। আমার ছাত্ররা এখনই চলে যাবে এখান থেকে।’ সামরিক সেনারা তার অনুরোধ শুনলো না। এমন সময় এলোমেলো অবস্থার মধ্যে কোত্থেকে যেনো আদেশ এলো ‘ফায়ার।’ শুরু হল এলোপাতাড়ি গুলি। ততক্ষণে বেশ কয়েকজন সামরিক সেনা তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্যাতন করতে শুরু করেন। বেশ কিছুক্ষণ পর মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে গাড়িতে তোলা হয়। তখন তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। পরে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শেষ বেলার আলোর মতোই নিভে গেল ড. জোহার জীবনপ্রদীপ।
প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহার স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়স্থ তার সমাধিকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে ‘জোহা চত্বর’, তার নামে নামকরণ করা হয় একটি ছাত্র হলেরও। ২০০৮ সাল থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে রাবিতে পালন করা হয় জোহা দিবস হিসেবে, সে বছরই মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন এই মহাত্মা। দুঃখজনক বিষয়, রাজশাহীর বাইরে এই সূর্যসন্তানকে নিয়ে স্মারক খুব কমই আছে। জাতীয়ভাবে তার স্মরণে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ‘শিক্ষক দিবস’ ঘোষণা করা হলে হয়তো কিছুটা সম্মান দেখানো হবে তাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. এম আব্দুস সোবহান বলেন, শহীদ ড. জোহা একজন নির্ভীক শিক্ষক ছিলেন। তার আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি। তার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আরও বেগবান হয়েছিল। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। উপাচার্য দিবসটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণার জোর দাবি জানান তিনি।