প্রথমেই নিজের কর্মব্যস্ততা থেকে এক মুহূর্ত সময় চেয়ে নিন। এবার ভাবুন তো, আপনার দিনটি কিভাবে শুরু হয় এবং কিভাবে শেষ হয়?
আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কিভাবে আপনার প্রত্যেকটি দিন কাটান? দিনের কতটুকু সময় নিজের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ব্যয় করেন আর কতটুকু সময় শুধুই নিজের আরাম-আয়েশে ব্যয় করেন?
উত্তর ভাবতে ভাবতে কয়েকটি তথ্য জেনে নেয়া যাক। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকার অধিবাসীরা যানজট সমস্যার কারনে প্রত্যেক কর্মদিবসে কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা করে সময় হারাচ্ছেন। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার কিছু অফিসে “অফিস প্রোডাক্টিভিটি” বিষয়ক একটি জরিপ চালানো হয়।
জরিপে অংশ নেয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, তারা নিজেদের একটি কর্মদিবসে পুরোপুরি কর্ম উৎপাদনশীল হিসেবে বিবেচনা করেন কি না?
উত্তরে শতকরা ৭৫ জন স্বীকার করেন তারা নিজেদেরকে তা মনে করেন না। ২০ শতাংশ বিশ্বাস করেন তারা সবসময় নিজেদের সবটুকু দিতে পারেন। আর বাকি ৫ শতাংশ কর্মকর্তা কর্মচারী আদৌ জানেন না তারা ঠিক পারেন কি না! এরপরে আর কাজের উপর কিছু জিজ্ঞেস করা হলো না।
তাদের কাছে জানতে চাওয়া হলো, যেদিন আপনি কাজ করেন না, তখন কি করে সময় কাটান বা কিভাবে সময় কাটে?
জরিপে অংশগ্রহণকারীরা একাধিক উত্তর দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাতে যে ফল পাওয়া গেছে তা হলো, শতকরা ৩২ ভাগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটান। সহকর্মীদের সাথে আড্ডায় সময় কাটান ১৬ ভাগ, ১৫ ভাগ ধূমপান/চা পান করে, ফোনকলে ১১ ভাগ, দুপুরের খাবার এবং নাস্তায় ১০ ভাগ, দেশ বিদেশের সংবাদ জানতে ৭ ভাগ এবং নতুন চাকরি খোঁজায় ৯ ভাগ সময় কাটান।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রথমে আপনার যানজটে পড়ে সময় নষ্ট হচ্ছে, তারপর আপনি দিনের একটা বড় সময় ব্যয় করছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও অন্যান্য কাজে। আপনি বর্তমানে যে কাজ করেন, আরো কম সময়ে সে কাজগুলো শেষ করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই বিকল্প রাস্তা খুঁজতে হবে। কারণ আপনার কাজের বর্তমান প্রক্রিয়াগুলো যতটা উপকারী হওয়ার কথা তা নাও হতে পারে।
কি করতে হবে এবং আপনার কোন দক্ষতাগুলো বাড়াতে হবে তা খুঁজে পেতে আপনার বর্তমান কাজের ফর্মূলাগুলোকে আরেকবার মূল্যায়ন করতে হবে। একবার যখন সঠিক পদ্ধতি পেয়ে যাবেন, তখন আপনি টু-ডু লিস্টের সংখ্যা না বাড়িয়ে কিভাবে আরো বেশি কাজ করা যাবে, সেই কৌশলগুলো নিয়ে কাজ করতে পারবেন।
ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স প্রোগ্রামে পড়ার সময় আমাদের একজন শিক্ষক বলেছিলেন, “Focus on being Productive, not Busy.”
আপনার কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপ হলো, একটি ব্যক্তিগত রুটিন তৈরি করা। দয়া করে বিখ্যাত ব্যক্তিদের এমন রুটিন অনুসরণ করবেন না যা আপনার সাথে যাবে না। নিজের জন্য নিজের মতো করে একটি রুটিন তৈরি করুন।
আপনার নিশ্চয়ই খুব ভালো ধারনা আছে যে দিনের কোন সময়টায় আপনি সবচেয়ে বেশি প্রোডাক্টিভ, মনযোগী বা শারীরিকভাবে সবল। অধিকাংশ মানুষই দিনের শুরুর ভাগে সবচেয়ে বেশি প্রোডাক্টিভ। তারা দুপুরের খাবারের আগের অংশেই অনেক বেশি ও ভালোভাবে কাজ করতে পারেন। এখানে রহস্যটি হলো, আপনার শরীর ও মনের মর্জি মতো কাজ করা, এর বিপরীতে গিয়ে নয়। কিছু আইটি কোম্পানি ও ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি তাদের কর্মীদের জন্য আরামদায়ক কাজের সময় নিয়ে এসেছে। যা আসলেই সেই কোম্পানিগুলোর জন্য ভাল ফল নিয়ে আসছে।
কখনো ভেবেছেন সপ্তাহের শেষ দিনের থেকে কেন আপনি সপ্তাহের শুরুতে বেশি কাজ করতে পারেন? কারণ সাপ্তাহিক ছুটির পর আপনার মন মেজাজ ভালো থাকে এবং এক নতুন আপনাকে পাওয়া যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনার এনার্জি লেভেল অনেক ভালো থাকে।
প্রোডাক্টিভিটির এক অন্যতম রহস্য হলো, আপনি কাজ কীভাবে শুরু করবেন? সপ্তাহের মধ্যে আপনি ছুটি নিতেই পারেন, আর বুধবারের পর আপনার শরীরে ক্লান্তি আসতেই পারে। কিন্তু আপনি যদি সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততার পর পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারেন, তাহলে প্রতিদিনের কাজগুলোকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
আমাদের মধ্যে অনেকেরই রাতে ঘুম খুব কমে যাচ্ছে। এটি আপনাকে অফিসে আরও একটি বিষণ্ণ সকাল শুরু করাবে। আপনার প্রোডাক্টিভিটি অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে, যদি সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে যদি খুব ভালো করে বিশ্রাম নিতে পারেন। এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বা ইমেইল থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেন। নিজের ফোন বা ল্যাপটপ ছাড়া ছুটির দিন কাটানো হয়তো অসম্ভব হতে পারে। কিন্তু সুখবর হলো, যদি আপনি এটাকে সম্ভব করতে পারেন, তাহলে সপ্তাহের শুরুতে আপনি কাজ করার জন্য অনেক বেশি এনার্জি পাবেন।
টু-ডু লিস্ট একটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। আপনার কাজের বিশাল তালিকা থেকে আজকের কাজগুলো আলাদা করুন। প্রতিদিন শুধু আজকের কাজগুলোতে মনোযোগ দিন। প্রতিদিন সকালে টু-ডু মাস্টার শিট দেখা আপনাকে কখনো কখনো বিভ্রান্তও করে দিতে পারে। তাই অফিস শেষে চলে যাবার আগে আগামীকালের প্রধান কাজগুলোর একটা তালিকা করে ফেলুন। হাতে ১৫-২০ মিনিট সময় রেখে লিখে ফেলুন কাল কোন পাঁচটি লক্ষ্য অর্জন করতে চান। কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা অনেক দেরি হয়ে যাবে কারণ ততক্ষণে দিনটা আপনার ঘাড়ে চেপে বসবে।
আপনার যদি খুব সকাল সকাল উঠার অভ্যাস থাকে, তাহলে দিনের মধ্যম ভাগেই আপনার কর্মশক্তি কমতে শুরু করবে এবং আপনি যা চাইছেন তা শেষ নাও করতে পারেন। তাই, আপ্রাণ চেষ্টা করুন সকালবেলা আপনার আজকের দিনের সব জরুরী কাজগুলো সেরে ফেলতে।
এনার্জি ম্যানেজমেন্ট আপনাকে কাজের ফলাফলগুলো চিন্তা করতে সহযোগিতা করে, আপনি কতটুকু সময় ব্যয় করেছেন সেই ব্যাপারে না। গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করলে খুব অল্প সময়েই অনেক কাজ করা সম্ভব হয়। মনোযোগ ছাড়া কাজ সারাদিন ধরে করলেও শেষ করা সম্ভব নাও হতে পারে। আপনি তখনই প্রকৃত ও সৃজনশীল কাজ পারবেন, যদি আপনি আপনার শক্তি ও সময়কে নিষ্ঠার সাথে পরিচালনা করতে পারেন।
আপনি যদি বুঝতে না পারেন সকালে সর্বপ্রথম কোন কাজটি করা উচিত, তাহলে কাজে বিলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। আপনার রুটিনটি কাজের একটি সহজ প্রক্রিয়া হতে পারে। যেমন, অফিসে যান, এক কাপ চা বা কফি পান করুন, আপনার ডেস্কটি গুছিয়ে নিন, আপনার আজকের টু-ডু লিস্ট দেখুন এবং ধারাবাহিকভাবে শুরু করুন।
কর্মক্ষেত্রে বেশি সময় কাটানো মানে এই নয় যে, আপনি বেশি কাজ করতে পারবেন। ভেবে দেখুন, একটি কাজ শেষ করার জন্য আপনার কাছে পুরোটা সকাল বা বিকেল সময় রয়েছে। তখন আপনি হয়তো এই কাজের ফাঁকে চা, কফি বা ধূমপানের জন্য কিছু সময় নিবেন, ইমেল বা সোশ্যাল মিডিয়া চেক করবেন এবং লম্বা সময় নিয়ে কাজটি শেষ করবেন। কিন্তু আপনি যদি একটি কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট সময় সেট করে নেন, তাহলে আপনি এতে পুরোপুরি ডুবে থাকবেন, কাজ করার শক্তি পাবেন এবং কম সময়ে কাজটি শেষ করতে পারবেন। যখন আপনার অনেক কাজ করতে হবে তখন প্রতিটি কাজের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিন। ‘ডেডলাইন’ আপনাকে কাজে ফোকাস করতে বাধ্য করবে।
লেখক : লাইফ হ্যাকিং ব্লগার ও কনটেন্ট মার্কেটিং স্পেশালিস্ট।