মসজিদে বিস্ফোরণ: অবৈধ বললেই কী দায় এড়ানো সম্ভব?

, যুক্তিতর্ক

মুফতি এনায়েতুল্লাহ | 2023-08-25 13:05:33

মৃত্যু মানেই কষ্ট। তবে কিছু কিছু অত্যন্ত বেদনার। নানা সময়ে আমাদের এমন কিছু বেদনার সাক্ষী হতে হচ্ছে। এ তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয়েছে নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লার বায়তুস সালাত মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা ২৬ জনের মৃত্যু। শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাতের ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় একে একে ২৬ জন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। এমন ঘটনায় দেশবাসী মর্মাহত, শোকাহত। যারা বেঁচে আছেন, তাদের অবস্থাও আশংকাজনক। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

বিস্ফোরণের পর পর আগুনের ভয়াবহতা সম্পর্কে বুঝা যায়নি। যত সময় গড়িয়েছে, বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যু ও আহতের ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। মসজিদে বিস্ফোরণে যারা নিহত হয়েছেন, আমরা তাদের আত্মার মাগফেরাত ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। তাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।

আগেই বলেছি মৃত্যু মানেই শোক। তল্লা এলাকার ঘরে ঘরে এখন চলছে শোকের মাতম। এ শোক ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। কিসে এবং কেন এই বিস্ফোরণ, এখন সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। এ নিয়ে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়া গেলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে আশা করা যায়।

প্রথমে বলা হয়েছিল, মসজিদের এসির বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। পরে এ ধারণা ভিত্তি পায়নি। মসজিদে থাকা সবগুলো এসি পুড়ে গেছে, তবে সেগুলো বিস্ফোরণে হয়েছে, এরূপ প্রমাণ মেলেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত এসিতে বিস্ফোরণ ঘটে না। এতে সামান্য গ্যাস থাকে বটে, তবে তা খুব একটা দাহ্য নয়। তাতে এত মানুষ অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কথা নয়।

বিস্ফোরণে নিহতদের লাশের কফিন, ছবি: সংগৃহীত

ইতোমধ্যেই খবর পাওয়া গেছে, এসির বিস্ফোরণ নয়, গ্যাস বিস্ফোরণেই এ মর্মন্তদ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। মসজিদে গ্যাসের কোনো সংযোগ নেই। তবে মসজিদের মেঝের নিচ দিয়ে গ্যাসলাইন নেওয়া হয়েছে। মসজিদ নির্মাণের আগে সেখানে গ্যাসলাইন ছিল। তা না সরিয়েই তার ওপর মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এটা মসজিদ কমিটি ও তিতাস গ্যাস কোম্পানির অসতর্কতা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই সম্ভব হয়েছে।

জানা গেছে, কিছুদিন আগে মসজিদের মেঝেতে গ্যাসের লিকেজ ধরা পড়ে। মসজিদ কমিটির তরফে বিষয়টি নারায়ণগঞ্জ তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, ঘুষ হিসেবে ৫০ হাজার টাকা না দেওয়ায় তিতাস কর্মকর্তারা মসজিদের লিকেজ সারেননি। নারায়ণগঞ্জের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আরেফিন জানিয়েছেন, মসজিদের সামনে গ্যাসের লাইনে লিকেজ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এসি চালানোর সময় জানালা-দরজা বন্ধ থাকায় ওই গ্যাস ভেতরে জমা হয়ে যায়। হঠাৎ কেউ বৈদ্যুতিক সুইচ অফ অন করতে গেলে স্পার্ক থেকে বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। তিনি আরও জানিয়েছেন, পানি দেওয়ার সময় মসজিদের মেঝেতে বুদবুদ করে গ্যাস বের হচ্ছিল, যা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষও পরে প্রত্যক্ষ করেছে।

অমনোযোগ, অবহেলা ও দায়িত্বশীলতার অভাব কী ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, মসজিদে বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনা তার একটি বড় প্রমাণ। উল্লেখ করা যেতে পারে, গ্যাস লিকেজজনিত বিস্ফোরণে মানুষের হতাহত হওয়ায় ঘটনা এই প্রথম নয়। আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যদিও মসজিদে এমন ঘটনা এই প্রথম।

গত বছর কোরবারির ঈদের দু’দিন পর শনিরআখড়ায় এক্সিম ব্যাংকে জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণে দু’জন মারা যায়। ওই ব্যাংকের নিচ দিয়েও গ্যাসলাইন ছিল। তার লিকেজ থেকে গ্যাস জমে ওই বিস্ফোরণ ঘটে। এছাড়া গত নভেম্বরে চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় গ্যাস বিস্ফোরণে সাতজন মারা গেছেন। বছরওয়ারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গ্যাস দুর্ঘটনায় ২০১৬ সালে ৪ জন, ২০১৭ সালে ৫ জন, ২০১৮ সালে ১৯ জন ও ২০১৯ সালে ৩২ জন মারা গেছেন।

মাটির নিচে গ্যাসলাইন, তার ওপর বাড়িঘর, দোকানপাট, রাস্তাঘাট ও স্থাপনা তৈরির ঘটনা অসংখ্য বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার আশকাংও তাই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তবে এসব ঘটনায় নিশ্চয়ই তিতাস কর্তৃপক্ষের যেমন অবহেলা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা। নিয়ম বহির্ভূত কোনো কিছুই যে সমাজের জন্য মঙ্গলজনক নয়, এই বিস্ফোরণ তার বড় প্রমাণ।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নারায়ণগেঞ্জর বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, মসজিদটি অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। যদি স্থানীয়রা বলছেন, মসজিদটি সম্পূর্ণ ওয়াকফ ভূমিতে মসজিদের নিজস্ব জায়গায় নির্মিত।

বিস্ফোরণের পর মসজিদের মেঝে, ছবিধ সংগৃহীত

অন্যদিকে ডিপিডিসির পূর্ব নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোর্শেদ বলেছেন, মসজিদের দু’টি বিদ্যুৎ সংযোগ লাইনের একটি অবৈধ ছিল। দু’টি সংযোগ লাইন নেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) নিয়ম মানা হয়নি।

তাদের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন হলো, মসজিদ নির্মাণের জায়গাটি অবৈধই হয়, তাহলে মসজিদ নির্মাণের সময় তিতাস কর্তৃপক্ষ বাধা দিলো না কেন? গ্যাসের পাইপলাইনটি তো বৈধ ছিল, তাহলে সেটার ত্রুটি সময়মতো সারানো হলো না কেন? মসজিদটি যদি অবৈধ জায়গায় হয়ে থাকে তবে এটা যাদের দেখার কথা তারা দেখলেন না কেন? তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ কেন অভিযোগ পেয়েও সম্ভাব্য ঝুঁকি নিরসন করল না? আর মসজিদ কমিটি, এলাকার জনপ্রতিনিধিরাই কী করেছেন? অবৈধ ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগইবা কীভাবে দেওয়া হলো? অবৈধভাবে নির্মিত বলে মসজিদে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন তো আর অবৈধ হয়ে যায়নি?

এসব প্রশ্নের উত্তর যথাযথ কর্তৃপক্ষকেই দিতে হবে। শুধু শোক বাণী, ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি, তদন্ত কমিটি, বিচারের আশ্বাস দিয়ে এমন নিষ্ঠুর ঘটনা বন্ধ করা যাবে না। দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। অন্যায়, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতা বারবার চলতে পারে না। এখনকার নারায়ণগঞ্জ, বিগত সময়ের নিমতলী, চকবাজার কিংবা রানা প্লাজার ঘটনার পরও যখন যথাযথ কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হয়নি; সেখানে হতাশা প্রকাশ ছাড়া আমাদের আর কী করার আছে? এই শোক কাটিয়ে অন্যকোনো ঘটনায় শোক প্রকাশের প্রস্তুতি ছাড়া?

বৈধ-অবৈধ বিতর্ক ছাপিয়ে আমরা চাই, এটাই হোক দায়িত্ববানদের দায়িত্বহীন কাজের শেষ স্মারক। সরকার তদন্ত করে দোষীদের বিচারের সম্মুখীন করুক। যাতে আর কোথাও এমন দুর্ঘটনা না ঘটে।

ইতোমধ্যে দেশের মসজিদ-মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎসংযোগ ও এসির অবস্থা পরীক্ষা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। নির্দেশটি ইতিবাচক তবে এর পরিধি বাড়ানো দরকার।

আমরা মনে করি, সকল বাড়িঘর, হাসপাতাল, দোকান-মার্কেট ও স্থাপনা এই নির্দেশের আওতায় আনা উচিৎ। একই সঙ্গে গ্যাসলাইনের বিষয়টিও সংযুক্ত করা প্রয়োজন। গ্যাসলাইনের বেশিরভাগ ঝুঁকিপূর্ণ থাকা মানে সর্বক্ষণ বিপদের আশংকার মধ্যে থাকা।

দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, তিতাসে সেবা বলে কিছু নেই, আর তিতাসের দুর্নীতি ওপেন সিক্রেট। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন যেহেতু গ্যাস সংযোগ বন্ধ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ কম। এমতাবস্থায়, লাইন দেখভাল করা, প্রয়োজনে সংস্কার করা ইত্যাদির পাশাপাশি সেবার মান বাড়ানোর দিকে তাদের নজর দেওয়া উচিৎ।

সর্বোপরি, তিতাসকে একটি দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক ও গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। আমরা আশা করবো, গ্যাসলাইন মেরামত, সংস্কার ও প্রতিস্থাপনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

মুফতি এনায়েতুল্লাহ: বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর