বিপর্যয়, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-29 12:04:53

উন্নয়নের জন্য বিপর্যয় বিপদের কারণ। সে বিপর্যয় হতে পারে প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক। উন্নয়নের স্থায়ীত্ব ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সব ধরনের বিপর্যয় এড়িয়ে স্থিতিশীলতা অক্ষত রাখাই সার্থক সরকার পরিচালনার অন্যতম পূর্বশর্ত।

খুব কাছের একটি উদাহরণ এ প্রসঙ্গে দেওয়া যায়। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের কেরালাকে বলা যেতে পারে উন্নয়নের 'ফার্স্ট বয়'। কিন্তু হঠাৎ বিপর্যয় রাজ্যটিকে ফেল-করা ছাত্রের কাতারে ঠেলে দিয়েছে, যার কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আবার অনেক সম্ভাবনাময় ও সমৃদ্ধ দেশের ভাগ্যেও এমন দুর্গতি হয়েছে রাজনৈতিক বিপর্যয়ে।

কেরালার উদাহরণে আবার ফিরে আসি। সব সময়ই কেরালা উন্নয়নের প্রশ্নে, সামাজিক সাফল্যের নিরিখে ভারতের প্রথম সারিতে রয়েছে। এমন কি, আর্থিক দিক দিয়ে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে, সর্বোপরি ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ বা মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে বলা হয় কেরালার ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ শুধু ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেই সর্বোচ্চ নয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে তুল্যমূল্য।

এমন এগিয়ে থাকা রাজ্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামলাতে অনেক পিছিয়ে থাকা রাজ্যদের মতোই ডাহা ফেল করছে। অর্থাৎ উন্নতি অর্জনই একমাত্র বিবেচ্য নয়, আরও বিবেচ্য হলো, যে কোনও ধরনের বিপর্যয় মোকাবেলা করার সামর্থ্য অর্জন করে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকে অক্ষূণ্নভাবে ধরে রাখা।

কেরালার অভিজ্ঞতা থেকে লক্ষ্যণীয় শিক্ষা হলো এটাই যে, উন্নত হলেই জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিপদ থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।

খোদ মার্কিন মুলুকেও এমন ঘটনা ঘটেছিল।  গত বছর (২০১৭) আমেরিকার একের পর এক বিপর্যয় প্রমাণ করেছে উন্নয়ন টিকিয়ে রাখতে হলে আরও কিছু কাজও করতে হয়। উদাহরণ হলো বস্টন, যে শহরকে বিপর্যয় রোধে গোটা বিশ্বে মডেল ভাবা হয়, তাও প্রায়-এক সপ্তাহ অন্ধকার ভূতের শহরে পরিণত হয়েছিল প্রবল ঝড়ের মুখে।

ভারতের কেরালাও তেমন পরিস্থিতিতে পড়েছিল। অবশ্য কেরালা কেন, বিশ্বের যে কোনও দেশই অকস্মাৎ এমন ঘোরতর বিপদে পড়তে পারে। কারণ, বিশ্বব্যাপী লোভী সরকার ও প্রশাসনের যোগসাজশে যেভাবে পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস করা হচ্ছে, তা বিপদের ঘোরতর বিপর্যয়কর পরিণত তৈরি করছে বিশ্বের নানা স্থানে। আবার এই আন্তর্জাতিক (অপ)বলয় বিশ্বের নানা স্থানে রাজনৈতিক হানাহানি, সংঘাত ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিরাট অংশে প্রতিদিন সেই বিপদ ও বিপর্যয়ের রক্তাক্ত প্রমাণ দিচ্ছে শত শত লাশ, হাজার হাজার নারী ও শিশুর রক্ত এবং লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল-উদ্বাস্তুর দিকশূন্য মিছিলের হাহাকারের মাধ্যমে।

এসব কারণে উন্নয়নের পাশাপাশি বহুবিধ বিপর্যয় এবং ভেতরের ও বাইরের বিপদ মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদও দেওয়া হচ্ছে। উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সেই উন্নয়নের প্রতিফলন ও তাকে সংরক্ষণের প্রতিও গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের তরফে। উন্নয়ন বলতে এখন কেবল বহুতল বানানোকে বোঝায় না, মানুষের চেতনার উন্নয়ন করে সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাকেও বোঝায়।

কেরালায় যে বিপর্যয় ঘটেছে, তাতে দেখা য়ায়, স্বক্ষমতার বিকাশ না করে উন্নয়ন বলতে কেবল উপার্জন ও নির্মাণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেখানে। তথ্য থেকে জানা গেছে, কেরালা থেকে বহু মানুষ, প্রায় প্রত্যেক পরিবার থেকেই, কাজের খোঁজে বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে যান ও সেখান থেকে বড় অঙ্কের টাকা উপার্জন করে দেশে পাঠান। বস্তুত কেরালার আর্থিক উন্নতির পিছনে এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়।

কিন্তু কিভাবে ব্যবহার হয় এই কুরিয়ার ক্যাশের বড় অংশ? জানা যায়, যা টাকা বিদেশ থেকে আসে তার অধিকাংশই খরচ হয় বিশাল বাড়ি বানাতে আর বাকিটা সোনা কিনতে। এই প্রবণতাই কেরালায় জন্ম দিয়েছে রিয়াল এস্টেট ব্যবসার রমরমার, যাকে হাওয়া দিচ্ছে পরিবেশকে পিছনে ফেলা সরকারি নীতি কিংবা দুর্নীতি।

প্রসঙ্গত বাংলাদেশ থেকে যে অজস্র মানুষ প্রতি বছর কাজের খোঁজে মধ্যপ্রাচ্যে যান, তারাও অর্থের একই রকমের ব্যবহার করেন। চট্টগ্রাম বা সিলেটের প্রবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোর দিকে তাকালে ঠিক একই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।

দুই জায়গার আর্থিক ক্ষমতায় আকাশপাতাল প্রভেদ, অথচ বিপর্যয়ের মুখে কেরালা আর বাংলাদেশের উপকূলের লণ্ডভণ্ড চিত্র অভিন্ন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ কেমন হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স যা পরিবেশকে পাত্তা দেয় না? বিপর্যয় ঠেকাতে পারে না?

আন্তর্জাতিক চিন্তা কাঠামোতে জিডিপি-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ভাবনাচিন্তার বিকল্প হিসাবে নব্বইয়ের দশকে সামনে আসা হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স গোড়া থেকেই স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মানকে হিসেবের মধ্যে ধরলেও পরিবেশকে ধরেনি, ধরেনি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকেও। সামগ্রিক ভাবে প্রাকৃতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে ভাবনা সত্তর দশকে শুরু হলেও, তা গতি পায় নব্বই দশকের শেষ থেকে। আরও বিশেষভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন তো কল্কে পেয়েছে ২০০৯ থেকে। ফলে ওই ‘ইনডেক্স’-এ যে পরিবেশ নামক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নেই, সেটা আশ্চর্যের নয়।

না-থাকার প্রসঙ্গটি অনেকের নজরে এসেছে। খোদ অমর্ত্য সেন, যিনি এই ইনডেক্স তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তিনিও পরবর্তী কালে এই দুর্বলতা স্বীকার করেন। আর এক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিটস ও ফরাসি অর্থনীতিবিদ জ্যঁ পল ফিতুসি তাঁদের ‘মিসমেজ়ারিং আওয়ার লাইভস’ বইটিতে ‘ভাল থাকা’ কী ভাবে মাপা যাবে, তা বলতে গিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নকে, এমনকি ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্টকেও।

বিশ্বজনীন চিন্তাবিদদের এই প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোকে নিজস্ব নীতি ও পরিকল্পনায় অনুসরণ না করা হলে তা প্রকারান্তরে কোটি কোটি মানুষকে ঠেলে দেয় বিপন্নতার হাইওয়েতে। কেরালায় যা ঘটেছে এবং বিশ্বের নানা স্থানে যে বহুমাত্রিক বিপর্যয় ঘটে চলছে, তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার দরকার আছে। দরকার আছে বিপর্যয়, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয়েরও।

এ সম্পর্কিত আরও খবর