কমিশনের নজর থাকুক নির্বাচনেই

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-27 04:10:18

অনেকেই তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই মুহূর্তে বাংলাদেশে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহালের আর কোনো সুযোগ নেই। সংবিধান সংশোধন করে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। এরশাদের পতনের পর তিনজোটের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তখনকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকেই পরে আওয়ামী লীগের দাবির মুখে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করে। বিএনপি কিন্তু তখন মোটেই তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে ছিল না। আবার এখন বিএনপির এর পক্ষে। আর আওয়ামী লীগের দাবির মুখে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আসলেও এখন তারা এর বিপক্ষে। রাজনীতিবিদরা সুবিধামত নিজেদের অবস্থান বদলাতে পারেন। তবে আমি বরাবরই তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিপক্ষে। কেন, সে ব্যাখ্যা পরে দিচ্ছি।

আপনাদের মনে থাকার কথা, মাগুরার উপ-নির্বাচনে অনিয়মের প্রতিবাদেই আওয়ামী লীগ তত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন শুরু করেছিল। তত্বাবধায়ক সরকারের মূল কারিগর মানি আমি তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফকে। তিনি যদি মাগুরা থেকে পালিয়ে আসার আগে নির্বাচনটা স্থগিত করে দিয়ে আসতেন, যার আইনগত এখতিয়ার তার ছিল, তাহলে বাংলদেশের রাজনীতির ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। এটাই বাংলাদেশের মূল সমস্যা। নির্বাচন কমিশন কখনোই তার ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করে না। এই সমস্যায় পরে আসছি।

তত্বাবধায়ক সরকারের জন্মটা দেখলাম, এবার মৃত্যুটা দেখে আসি। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবিধান থেকে তত্বাবধায়ক সরকার বিলোপ করা হয়েছে, তাই দায় বা কৃতিত্বটা শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে। তকে কেউ কেউ তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের দায় বা কৃতিত্ব সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে দিতে চান। তার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। যদিও তার রায়ে অন্তত দুটি নির্বাচন তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার সুপারিশ ছিল। কিন্তু সংসদ তত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সুপারিশ পাশ করেছে, আরো দুটি নির্বাচন এ সরকারের অধীনে করার সুপারিশটা মানেনি। মানলে ভালো করতো। তত্বাবধায়ক সরকারের জন্মের নেপথ্যের দায় যেমন বিচারপতি রউফের, তেমনি এর মৃত্যুর মূল কৃতিত্ব ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের। পছন্দের প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা বানাতে বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তখনকার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ। আর এর মাধ্যমেই তত্বাবধায়ক সরকারের ধারনার মৃত্যু ঘটে। তবে তত্বাবধায়ক সরকারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। বিচারপতি কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টা হতে অস্বীকৃতি জানানোর পর অন্য কোনো অপশন যাচাই না করে নিজেই রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা উপদেষ্টার পদও দখল করে নেন 'ইয়েসউদ্দিন' হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই সাবেক শিক্ষক। সেই জটিলতা মেটাতে ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দীন সরকার দুইবছর দেশ চালিয়েছে। মওদুদ তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে কফিনবন্দী করেছেন, ইয়াজউদ্দিন তাতে শেষ পেরেক ঠুকেছেন। খায়রুল হক ও শেখ হাসিনা মিলে পেরেকবন্দী সেই কফিনের দাফন সম্পন্ন করেছেন মাত্র।

জেনে হোক বা না জেনে হোক যারা যারা তত্বাবধায়ক সরকারের বিলোপের জন্য দায়ী, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। কারণ আগেই বলেছি আমি বরাবরই নীতিগতভাবে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিপক্ষে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্বাবথায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলা হয়েছে। কারণ সংবিধানে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। তত্বাবধায়ক সরকারের ধারনাটাই অগণতান্ত্রিক। তবে আমার বিবেচনা অন্য। আমার বিবেচনায় তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাজনীতিবিদদের প্রতি অনাস্থা আর অবিশ্বাসের জ্বলজ্বলে এক উদাহরণ। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার ব্যাপারে যাদের ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারি না, তাদের কাছেই দেশটা ছেড়ে দিতে হয় ৫ বছরের জন্য।

তত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। বিশ্বের প্রায় সব দেশে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাদের দেশের রাজনীতিবিদরা যে খুব ভালো, তা নয়। তবে তাদের নির্বাচন কমিশন সত্যি সত্যি স্বাধীন, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ। আমাদের দুঃখটা এখানেই। একটা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনই আমাদের ভাগ্যে জোটে না। ইদানীং সার্চ কমিটি করে, সব দলের মতামত নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হয় না। যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ।

অনেকে আইন সংশোধনের কথা বলেন। কিন্তু বিদ্যমান আইনে নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেয়া আছে, তার সঠিক প্রয়োগই সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের নির্বাচন কমিশন তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে না। আমার ধারণা তারা জানেনওনা তাদের ক্ষমতা আসলে কতটুকু। তারা তাকিয়ে থাকে পছন্দের দলের ইশারার দিকে। কখনো কখনো ইশারাও লাগে না।

গতবছর নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মতবিনিময় করে। তাতে একশোরও বেশি সুপারিশ উঠে আসে। কিন্তু কোনো সুপারিশই আমলে নেয়নি কমিশন। তাহলে মতবিনিময় করা হলো কেন? কোনো সুপারিশ আমলে নেয়নি, এটা বলা ঠিক হলো না। নির্বাচনের যখন চার মাস বাকি তখন তারা নির্বাচনের বেসিক প্রস্তুতি ফেলে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নিলো। ইভিএম আমিও চাই এবং জানি একসময় যুগের চাহিদায় সব দল মিলে ইভিএম চাইবে। কিন্তু এই সময়ে ইভিএম'এর মত একটা জটিল ও বিতর্কিত বিষয়কে সামনে আনতে হলো কেন? আওয়ামী লীগও ইভিএম ব্যবহারে জোর দাবি তুলেছে, এমন নয়। তবে মতবিনিময়কালে আওয়ামী লীগসহ ৭টি দল ইভিএম'এর পক্ষে, বিএনপিসহ ১২টি ছিল বিপক্ষে। নির্বাচন কমিশন হঠাৎ করে সংখ্যালঘু দলের দাবি নিয়ে সামনে নিয়ে এলো কেন? সরকারি দলের প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রমাণ করতে? কিন্তু বাস্তবতা হলো সব দল চাইলেও চার মাসে কেন চার বছরেও ইভিএম ব্যবহার সম্ভব নয়। এটা করতে হবে ধাপে ধাপে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন দুদিন পর ইভিএম ব্যবহারে তাড়াহুড়ো না করার পরামর্শ দিলেন, পরদিনই প্রধান নির্বাচন কমিশনার পিছিয়ে এলেন। এখন কেউ যদি অভিযোগ করে, নির্বাচন কমিশন সরকারের ইশারায় চলে, তাহলে কি তাকে দোষ দেয়া যাবে?

নির্বাচন কমিশনকে আরো হাস্যকর করে তুলেছেন অর্থমন্ত্রী। নির্বাচন কমিশন ঘোষণার আগেই তিনি আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে ২৭ ডিসেম্বরের কথা বলে দিয়েছেন। সাধারণ কোনো মানুষ হিসাব-নিকাশ করে একটা সম্ভাব্য তারিখ বের করা এক কথা আর অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা আরেক কথা। সবার আপত্তির মুখে পরদিন অর্থমন্ত্রী বলেছেনন, এটা তার নাগরিক মন্তব্য। কিন্তু মন্ত্রিসভার সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য যখন নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করে দেন, তখন সেটা আর নিছক নাগরিক মন্তব্য হিসেবে মেনে নেয়া যায় না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যতই বলুন, নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সাথে তাদের কোনো কথা হয়নি, মানুষ বিশ্বাস করবে না। কেউ যদি অভিযোগ করে, সরকারি দলের নেতাদের সাথে পরামর্শ করে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ঠিক করছে, তাকে কি দোষ দেয়া যাবে? অর্থমন্ত্রী গোপন কথা ফাঁস করে দেয়ায় নির্বাচন কমিশন অস্বস্তিতে পড়েছে। তবে এমন অস্বস্তি নির্বাচন কমিশনের এই প্রথম নয়। গত ফেব্রুয়ারিতে একই ধরনের সমস্যায় পড়েছিল কমিশন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটগ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ ছিল ১৯ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু তফসিল ঘোষণার আগেই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সেটা ফাঁস করে দেয়ায় বিপাকে পড়েছিল কমিশন। পরে ভোটগ্রহণের তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করে বিব্রতকর অবস্থাটি এড়িয়েছিল কমিশন।

তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। বাকি সবার কাজ হলো চাহিদা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। নির্বাচনের সময় সব ধরনের পোস্টিং-বদলি হওয়ার কথা কমিশনের নির্দেশে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বোধহয় সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করার ইচ্ছা বা সাহস কোনোটাই নেই। কিন্তু ব্যক্তি যদি যথেষ্ট শক্ত না হন, আইন বা পদ্ধতি বদলে লাভ হবে না। এখন নিজেদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন কি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মত সংসদ নির্বাচনের তারিখও পাল্টে দেবে? ভোটগ্রহণের তারিখ ২৭ ডিসেম্বরের বদলে অন্য কোনো দিনে নিয়ে যাবে? সাধারণত জাতীয় নির্বাচন সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন মানে বৃহস্পতিবার হয়। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যকে ভুল প্রমাণ করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে হয় ২০ ডিসেম্বর নয় ৩ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন কি সেটা করবে? নাকি অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত তারিখেই ভোটগ্রহণ হবে?

নির্বাচনের আর চার মাসেরও কম সময় বাকি। নির্বাচন কমিশনের এখন নাওয়া খাওয়া ভুলে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের এখন বেহাল দশা। তারা ব্যস্ত ইভিএম আর অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব দেয়া নিয়ে। ইভিএমকে ঘিড়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে বিভক্তিটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। নির্বাচন কমিশনকে আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে নিজেদের মতদ্বৈধতা মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দৃঢ়তার সাথে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে।

আগামী নির্বাচন দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ণ। নির্বাচন কমিশনের সামনে সুযোগ ইতিহাসে নতুন করে লেখানোর, তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে চিরতরে ভুলিয়ে দেয়ার। কিন্তু তারা যদি সেটা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে। আগের মত নিন্দা-মন্দই শুনতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। অবশ্য হেরে গেলে কারচুপির অভিযোগ তোলার অভ্যাস আমাদের পুরোনো। সে প্রসঙ্গ আলাদা।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর