মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সদর্থক পদক্ষেপ

, যুক্তিতর্ক

নারায়ণ নন্দী | 2023-09-01 11:33:04

স্বাস্থ্যই সম্পদ, যদি তা নীরোগ ও সুস্থ হয়। কিন্তু যদি তা না হয়, তবে দুর্ভোগ ও কষ্টের অন্তঃ নেই। এই স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক ও মানসিক, উভয়টিকেই গণ্য করতে হবে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ১০ অক্টোবরে সামগ্রিক স্বাস্থ্যগত ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের ভূমিকা ও গুরুত্ব বিশদে আলোচনার দাবি রাখে।

প্রতিটি মানুষই নীরোগ, সুন্দর, আনন্দময় জীবনযাপন করতে চায়। কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো মানে শুধু শরীর নয়, মনও ভালো থাকা জরুরি।কেননা মন ভাল না থাকলে কিছুই ভালো লাগেনা। জীবনে সবকিছুই অর্থহীন, নীরস মনে হয়। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, সুস্থ শরীর ছাড়া সুস্থ মন সম্ভব নয়, একইভাবে সুস্থ মন ছাড়াও সুস্থ শরীরও সম্ভব নয়। শরীর ও মন একে অপরের পরিপূরক।

প্রতিবছর সমগ্র বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ১০ ই অক্টোবর দিনটি বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস রূপে পালিত হয়। আসলে মানুষের সুস্থতা তখনই আসে, যখন শরীর-মনে সে পুরোপুরি সুস্থ থাকে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য আজও থাকে অবহেলাতেই রয়েছে। এদিকে যথেষ্ট নজর দেওয়া হয় না।

১৯৯২ সালের ১০ ল অক্টোবর প্রথমবার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উদযাপিত হয়। লক্ষ্য ছিল সমগ্র বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন করা। এই দিনটি প্রথম বিশ্বব্যাপী ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ এর উদ্যোগে পালিত হয়েছিল। ১৯৯৪ সাল থেকে বিশেষজ্ঞ ইউজিন ব্রাডির পরামর্শ ও সক্রিয় উদ্যোগে প্রথম এই দিনটি সঙ্গে একটি বিশেষ থিম পালন করা হয়। বিগত বছরে এর থিম ছিল মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রচার ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ ।বর্তমান বছরের (২০২০) থিম Move for mental health: lncreased investment in mental health অর্থাৎ সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যে অধিক বিনিয়োগ ও অবাধ সুযোগ।

তাছাড়াও বিগত বছরগুলোতে  পরিবর্তিত বিশ্বে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য, কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য ও  প্রাপ্তবয়স্ক, হতাশা একটি গ্লোবাল ক্রাইসিস, শিশু ও মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। তদুপরি বিশ্বে কয়েকটি দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সপ্তাহ পালন করা হয়ে থাকে।

১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- হু (WHO)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো মানসিক স্বাস্থ্য। শরীর ও মনে সতেজ থেকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সুস্থভাবে জীবনযাপনই হলো মানসিক সুস্থতার লক্ষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন ব্যক্তি মানসিক সমস্যার আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সেটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। অথচ একটু ঠিকঠাক চিকিৎসা করতে পারলে এর প্রতিরোধ সম্ভব।

মানসিক মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে কোন ব্যক্তি পরিবারে, পেশায়, সমাজের খাপ খাওয়াতে পারে না। তার মধ্যে হতাশা অথবা অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। জীবনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কখনো কখনো সমস্যাগ্রস্ত লোকটি আত্মঘাতীও হয়ে পড়েন।

সারা বিশ্বে প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত বলে গবেষকগণ দাবি করছেন। তাছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে বাড়ছে হীনমন্যতা, হতাশা, আত্মহত্যা প্রবণতা ও নানা নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা। যে সকল মানুষ আত্মহত্যা করেন, তারা যে সে সময় মানসিকভাব অসুস্থ থাকেন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যথাযথভাবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে এর প্রতিরোধ সম্ভব।তাই মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অন্তর্ভুক্ত করতে দাবি উত্থাপিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা শরীরের পাশাপাশি মনের যত্ন নিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন । মানসিক অসুস্থদেরকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখতে বলছেন। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে বন্ধুর মতো মিশতে আহ্বান করছেন। তার সমস্যা দূরীকরণে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পরিবার, বন্ধু ও সমাজের সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করছেন।

অধিকাংশ মানসিক রোগীকে চিকিৎসা দ্বারা সুস্থ করা সম্ভব বলেও গবেষকদের অভিমত। প্রয়োজনে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিয়ে চিকিৎসা করার প্রতিও জোর দেওয়া হয়েছে। শুধু রোগি নিজে নয়, পরিবার ও সমাজের সকলকে এগিয়ে এসে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ জাতি গঠনে সকলকে উদ্যোগ নিতে বলছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে 'সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে' মর্মে মূলমন্ত্রটি অনুসরণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

সারা বিশ্বের মতো ১০ অক্টোবর মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে বাংলাদেশেও। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার প্রয়াস চলছে। বাংলাদেশ ২০০১ সালে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নির্মাণ বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা অধ্যায়, এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, স্বাস্থ্যসেবা ইতিহাসে এক মাইলফলক। দিনটির গুরুত্ব সম্পর্কে  মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।

তাই মানসিক স্বাস্থ্য উদ্ধারে কোন ব্যক্তিকে শুধু শারীরিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে নয়, পারিবারিক  ও সামাজিক সমর্থন দেওয়া জরুরি। জরুরি ইতিবাচক বা সদর্থক মনোভাব পোষণ করে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করা। জীবনকে আনন্দময় করতে, সঠিক ছন্দ ফিরে পেতে, সর্বক্ষেত্রে অর্থবহ করতে, শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক সুস্থতাও যে অতি জরুরি, এই সত্য সবাই যখন অনুধাবন  করবেন, তখনই সমস্যাটি দূর করা সহজ হবে এবং সমাজে সুস্থ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

লেখক, সহকারী অধ্যাপক, সরোজিনী নাইডু কলেজ ফর উইমেন, কলকাতা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর