মাদক: জীবনের রৌদ্র নিভে গেলে

, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-09-01 00:24:12

এক.

কদিন ধরে নির্ধারিত জায়গায় যুবকটিকে দেখতে পাচ্ছি না। তার বদলে একটি শিশুকে দেখছি। শিশুটির সঙ্গে যুবকটির অবয়বের একটা মিল আছে। শিশুটির বযস বড়জোর ১০-১২ বছর হবে। নাবিস্কো মোড় সংলগ্ন অগ্রণী ব্যাংকের সাথের ফুটপাতেই যুবকটির দেখা পাই। বাদাম ভাজা আর বুট ভাজা বিক্রিই তার পেশা। ওর নাম কখনো জানতে চাইনি। তবে কয়েক বছর ধরে ওর নিয়মিত ক্রেতা হিসেবে একটা আলাপের সম্পর্কই গড়ে ওঠেছে। কথায় কথায় জেনেছি ওর বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। নিজেদের কিছু জমিজিরাত আছে তাতে বাদামের চাষ হয়। সেই বাদাম বস্তা ভরে ঢাকায় আনে তারা। তারপর নিজেরাই ভেজে এই শহরে বিক্রি করে।

গত কয়েক মাস হোল হঠাৎ করে বাদামের দাম বেড়েছে কিন্তু ভৈরবের এই বাদাম বিক্রেতারা খুচরা দাম বাড়ায়নি। কারণ তারাই বাদামের উৎপাদক বলে মধ্যস্বত্বভোগীর উপরি খরচটা তাদের লাগে না। নিজেদের জমির ফসল বাদাম এনে এই শহরে ভেজে নিজেরাই বিক্রি করতে পারে বলে দাম না বাড়িয়েই এই কাজটা চালিয়ে যেতে পারছে । এইসব টুকিটাকি কথা হয়। প্রায়ই দেখি মোবাইর ফোনে মশগুল থাকে। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম মোবাইলে এতো কথা বললে বেচা বিক্রি হবে কখন? হাসতে হাসতে বললো ছেলের খোঁজ নিচ্ছিলাম। স্বুলে যেতে চায় না। বাড়িতে তার মার কথাও শোনে না। ওকেই বোঝাচ্ছিলাম। ভাল লাগল, দায়িত্বশীল পিতা হিসাবে এই বাদাম বিক্রেতাও নিজের সন্তানকে নিয়মিত স্কুলে পাঠাচ্ছেন শুধু না, স্কুলে যাচ্ছে কিনা সেই খোঁজও নিচ্ছেন মোবাইল ফোনে। এইতো ডিজিটাল বাংলাদেশ! আমরা শুধু মোবাইল ফোনের নিন্দামন্দ করি। এর ভাল দিকও তো কত আছে!

সপ্তাহের প্রায় দিনই যুবকটিকে নির্দিষ্ট জায়গায় বাদাম বিক্রি করতে দেখি। মাঝে মাঝে শনিবারে তাকে অনুপস্থিত দেখে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, শনিবারে কই যাওয়া হয়। যুবকটির মিষ্টি হাসি। বললেন, ভৈরবে নিজের বাড়িতে যাই। শনিবারে ছুটির দিন। অফিস আদালত খোলা থাকে না। লোকজনের আনাগোনা কম। বিক্রিও হয় না তেমন। ঢাকায় থাকলে খাওনা খরচা তো আছেই। তাই বাড়ি যাই। আমি আরও কৌতুহলি হয়েই জানতে চাই যাওয়ার ভাড়া লাগে না। তাও তো কম না। সটান উত্তর পেলাম, খরচা তো তেমন না। ট্রেনে যাই টিকেট তো কাটা লাগে না, কয়টা টাকা ধরায় দিলেই হয়।

যুবকের জীবনযাপনের অর্থনীতি পরিষ্কার। বিক্রিবাট্টা কম হলে আয় কম হয় অথচ ঢাকায় খাবার খরচসহ দৈনন্দিন খরচ তো কম না। সেটার চাইতে অনেক কম টাকা খরচ করে নিজের বাড়িতে পরিবার পরিজনের সাথে কাটিয়ে আসা যায়, খরচাও কম লাগে। সিম্পল ইকোনমিক্স। পাশাপাশি দেশের ট্রেনের ব্যবস্থাপনার বিষয়টাও পরিষ্কার হয়। দাড়িয়ে বসে বহু লোক ট্রেনেই যাতায়াত করে। এখন ট্রেনের অনেক জনবল আউটসোর্সিং করে হয় বলে ট্রেনের মধ্যে হরেক কিসিমের লোকজনের দেখা মেলে। প্রতি বগিতে একজন অ্যাটেনডেন্স থাকে। এরা আউটসোর্সিং করা কোনো বেসরকারি কোম্পানির নিয়োগ করা লোক। এদের কাজ ওই বগির লোকজনের সেবা করা। তারা রেলের কোন কর্মচারি নন। কিন্তু তারাই ওই বগির মালিক। টাকার বিনিময়ে যাত্রী তোলা আর নামানোই তার প্রধানতম কাজ। এই উপরি আয়ই তার সেবার প্রধান লক্ষ্য। এদের সঙ্গে রেলের পুলিশ, রেলের টিকেট চেকার সবার সসম্পর্ক আছে। সবাইকে দিয়ে থুয়ে খায় বলে এদের একটা সরবারহ চেইনও গড়ে উঠেছে। নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত। রেলখাতে বছর বছর যে লোকসান হয় তার বড় অংশ এই চোরাখাত।

যা হোক, ধান ভানতে শিবের গীতে চলে এসেছি। যুবকটির কথাতেই ফিরে যাই। শিশুটি বেশ চটপটে। বাদাম ভাজা কিনতে যেয়ে জিজ্ঞেস করি, এইখানে যে লোকটা বসতো সে কি তোমার কেও হয়? বেশ সপ্রতিভ শিশুটি জানায় উনি আমার বাবা। আমি দুপুর পর্যন্ত এখানে বিক্রি করি আর দুপুরের পর বাবা এসে এখানে বিক্রি করবে। আমি মোড়ের উল্টো দিকে দোকান নিয়ে বসবো।

দুই.

শিশুটির কথা শুনে একটু অবাক হই। যুবকটির ওপর ভীষণ রাগও হয়। এ কেমন বাবা, স্কুল থেকে ছুটিয়ে এনে শিশুটিকে বাদাম বিক্রির কাজে লাগিয়ে দিয়েছে! পরের দিনই যুবকটির সাথে দেখা। আমি একটু রেগেই তাকে বললাম, ওইটুকু বাচ্চাকে কাজে লাগিয়ে দিলে। স্কুল বাদ!

যুবকটি একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বললো সাধে কি এনেছি? এলাকায় স্থানীয় নেতারা ওকে দিয়ে ইয়াবা টানায়। ওর তো সর্বনাশ করে ফেলবে। তাই ঢাকায় এনে কাজে লাগিয়ে দিলাম। আপাতত তো মাদক টানার কাজ থেকে বাঁচুক!

বুঝলাম সারা দেশে যে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে, তাতে মাদক সরবরাহ কাজে খুব একটা ভাটা পড়েনি। সরবরাহ চেইন অক্ষুন্ন রেখে, মাদক অর্থনীতির মূল চাকাটা সচল রেখে, ক্রসফায়ার চালিয়ে খুব একটা লাভ হয়নি। হবেও না। মাঝখানে কতগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যকাণ্ড ঘটিয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিই কেবল ক্ষুণ্ন হলো।

কেননা আজই সংবাদপত্রে দেখলাম, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেত জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৩৯তম অধিবেশনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বাংলাদেশের মানবাধিকারের মান বিষয়ে কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানে আটক আর বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগের খবর উদ্বেগ তৈরি করেছে। মাদকবিরোধী অভিযানে ২২০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি, কয়েক হাজার মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগও রয়েছে।

অবশ্য আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। বরং মানুষের আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রতি আস্থা বেড়েছে।

তিন.

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের সভাপতির কথা আর আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে আপাতত কথা না বাড়াই। আমি যে জায়গাতে ফোকাস করতে চাই তা হচ্ছে মাদকের সর্বগ্রাসি রূপ নিয়ে। মাদকের অর্থনীতির আয়তন দিন দিন বড় হচ্ছে। যারা মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তাদের সাথে মাদক সরবরাহকারীদের আঁতাত অক্ষুণ্ন আছে। যারা ক্ষমতাবান তারাই এই মাদক অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই ক্ষমতাবান নেক্সাস বা সিন্ডিকেট বাঁচিয়ে রেখে দেশকে মাদকের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না। আবার ক্রসফায়ার চালিয়েও যে কাজ হবে না, তাতো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
এখন তাহলে উপায় কী?

মাদকবিরোধী লড়াই আসলে একটা সুশাসনঘটিত সংকট। রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত না হলে আলাদা করে এই সংকট সমাধান অসম্ভব। কেননা, সুশাসনের ঘাটতি আছে বলেই কথিত মাদক সম্রাটরা ধরা ছোয়ার বাইরে আছেন। সুশাসন এখানেও বড় কামড় বসাতে পারছে না। রাজনৈতিক অর্থনীতির একটা বড় চালান এখন আসে মাদক থেকে। তাই এই মাদক অর্থনীতির বিকাশ সহজ ও সর্বত্রগামী হওয়ার সুযোগ বেড়েছে। চাইলেই এর বিনাশ অসম্ভব। আমাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির এই সরবরাহ চাঙ্ক ভাংতে হলে অনেক বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। দরকার মাদকবিরোধী লড়াইয়ে সকল রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে একটা ঐক্যমত। সেটা আদৌ সম্ভব কিনা সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।

তবে এটাও ঠিক সমাজের উঁচুতলা থেকে সমাজের নিচুতলা পর্যন্ত সর্বত্রই মাদক একটা সর্বগ্রাসী সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলে ভয়ানক ক্ষতির বন্দোবস্ত সেরে ফেলেছে। আমরা যদি ক্ষুদ্রস্বার্থ ভুলে এই জায়গায় আঘাত করতে না পারি তবে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। সেকারণেই মাদক নিবারণের উপায়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। আমরা যদি ক্ষমতার কাঠি হাতে নিয়ে, সুশাসনের মৃত্যু ঘটিয়ে নিত্যদিন জীবনের রৌদ্র নিভিয়ে দিতে থাকি তবে জাতির ভবিষ্যত বিপন্ন হতে বাধ্য। বড়লোক, গরীব, উচ্চবিত্ত, সর্বহারা সবার জীবনেই মাদকের বিষাক্ত ছায়া ঝেঁকে বসেছে ভয়ংকর ভাবে। মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাই ফাঁকি রাখলে চলবে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর