ভুল চিকিৎসা, অচিকিৎসা ও অপচিকিৎসা!

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 10:30:34

এশিয়ার মানুষগুলোর নিয়তি মনে হয় চিকিৎসাহীনতায় বন্দি। হয় 'ভুল চিকিৎসা', নয় 'অপচিকিৎসা' কিংবা 'অচিকিৎসা' যেন অক্টোপাসের মতো অষ্টেপৃষ্টে জিম্মি করে রেখেছে মানুষদের। বাস্তবতার চিত্র ও পরিসংখ্যান অন্তত তা-ই বলছে। আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি ও সমস্যা তীব্রতা এখন আর এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সমস্যা কেবল বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়া এবং বৃহত্তর এশীয় অঞ্চলেই প্রকট।একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, ভারতে অচিকিৎসায় মৃত্যু হয় বৎসরে অন্তত আট লক্ষ আটত্রিশ হাজার ব্যক্তির। আর হাসপাতালের দ্বারস্থ হওয়ার পরেও কম চিকিৎসায় কিংবা মন্দ চিকিৎসায় প্রাণ হারান আরও অন্তত ষোলো লক্ষ। অর্থাৎ ভারতে প্রতি বৎসর তেইশ লক্ষেরও অধিক মৃত্যু ঘটিছে চিকিৎসা পরিষেবার অপ্রতুলতা এবং অক্ষমতায়।

পাশাপাশি, অচিকিৎসা বা অপচিকিৎসায় মৃত্যুর হার ভারতে এক লক্ষ মানুষে একশো বাইশ। চীনে এই হার এক লক্ষে ছেচল্লিশ, বাংলাদেশে সাতান্ন, থাইল্যান্ডে বত্রিশ।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর করুণ চিকিৎসা-তথ্য সত্যিই লজ্জাজনক এবং হতাশাব্যঞ্জক। তবে তা কিন্তু বিস্ময়কর নয়। আশেপাশে তাকালেই বিপন্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও নিম্ন মানের চিকিৎসা পরিস্থিতি চোখ এড়ায় না। ভুল ও অপচিকিৎসায় মর্মন্তুদ ঘটনার ফিরিস্তিও কম লম্বা নয়। এইসব পরিসংখ্যান বাস্তবতার নিষ্ঠুর প্রতিফলন।

এইসব তথ্য ও পরিসংখ্যান বিদ্যমান স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতের নিদারুণ অবস্থারই বাস্তব চিত্র। জনগণের জীবনেও তা ছাপ ফেলছে। ভুল চিকিৎসা অথবা অপচিকিৎসা হয়ে হানা দিচ্ছে ব্যক্তিজীবনে। প্রায়ই দুঃখজনক অভিজ্ঞতার করাল গ্রাসে জীবন ও সংসার তছনছ হয়ে যাচ্ছে চিকিৎসার্থে আগত মানুষদের। ভুল ও অপচিকিৎসার কারণে জীবন বাঁচাতে-আসা মানুষজন জীবন হারিয়ে লাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে।

ভুল ও অপচিকিৎসায় প্রাণ ও অঙ্গহানির বিরুদ্ধে কখনো কখনো মামলা-মোকদ্দমা হয়। প্রতিবাদে মিছিল, মিটিং, মানব-বন্ধনে উচ্চকিত হয় গণমানুষ। কিন্তু এতে করেও কোনও অপরাধীর শাস্তি হওয়ার রেকর্ড নেই। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বিরাজমান নৈরাজ্য কমার বদলে বাড়ছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় দাপটের সঙ্গে অবস্থানকারী অর্থলোভী সিন্ডিকেটের কারণে অপরাধীদের কিছুই করা যাচ্ছে না।

চিকিৎসার অভাবে অথবা ভুল চিকিৎসায় যিনি প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁর আক্ষেপ কখনও প্রশমিত হয় না। এই কষ্টের জন্য কেউ কেউ হয়ত আজীবন নিজের অক্ষমতাকে দুষতে থাকেন, কেউ মন্দ কপালকে, কেউ বা ডাক্তারকে। এসবের সঙ্গে সঙ্গে দুষতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য-চিকিৎসা প্রশাসনের ব্যর্থতাকেও। এবং অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে এ খাতের অপশক্তিটিকেও, যারা মানবতাবাদী পেশার কলঙ্ক সৃষ্টি করে মানুষের জীবন ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মরণ খেলায় লিপ্ত রয়েছে।

দুঃখজনক সত্যি হলো, বাংলাদেশ বা এশিয়ার দেশগুলোতে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে সামান্যতম জবাবদিহিতা নেই। মানুষের অঙ্গ ও জীবননাশক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে তা উন্নত করার উদ্যোগও নেই। আত্মসমালোচনার সৎ ও সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে কাউকে ভুল স্বীকার করে এগিয়ে আসতেও দেখা যায় না। মনে হয়, মানুষের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে এ যেন এক চলমান ব্যবসা! এহেন কর্মকাণ্ড অবশ্যই থামানো দরকার।

এই প্রথম সারা বিশ্বে অচিকিৎসা বা অল্প-চিকিৎসায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান সংগৃহীত হল। তাতে দক্ষিণ এশিয়ার স্থান পশ্চাতে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যতই আস্ফালন করুন, নাগরিকগণ আছেন বিপদে ও পিছনের কাতারে। রহিয়াছেন অনেক পশ্চাতে। ফলে এখন প্রশ্ন করার সময় এসেছে যে, অপ ও অচিকিৎসার অবসান সত্যি সত্যি কবে হবে?

এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে যত চিকিৎসক প্রয়োজন, তত নাই। নার্স বা চিকিৎসাকর্মীও যথেষ্ট নাই। যত রোগী তত শয্যা নাই। সরকারি সেবার বদলে বেসরকারি খাতে অর্থের বিনিময়ে কাজ করার প্রবণতা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অধিক কার্যকর। এসব সমস্যার কথা কারে অজানা নহয়। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বাড়িয়ে যথেষ্ট চিকিৎসক তৈরি করতে, যথেষ্ট প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরি করতে যে উদ্যোগ প্রয়োজন, তা চোখে পড়ে না। চিকিৎসকদের সরকারি হাসপাতালে বা নিভৃত গ্রাম-গঞ্জে থাকা বাধ্যতামূলকও করা হচ্ছে না। ফলে গ্রামাঞ্চলে রোগীদের একটি বড় অংশ চিকিৎসা পাচ্ছে না। বরং ডিগ্রিহীন চিকিৎসকের ভরসায় অপচিকিৎসার কবলে নিপতিত হচ্ছেন। এই অপ ও ভুল চিকিৎসা নামকরা বেসরকারি ক্লিনিকেও দেখা যাচ্ছে।

অর্থলোভী ও অপ্রশিক্ষিত চিকিৎসকেরা রোগীর উপকার না কি অপকার করছেন? তাঁদের উপস্থিতি সত্ত্বেও প্রতি দিন মন্দ চিকিৎসায় হাজার হাজার লোকের মৃত্যুর পরিসংখ্যান কি প্রমাণ করে? স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। নিজেদের মানবিক ও মুনাফালোভী মনোবৃত্তি এবং অপ-ভুল-অচিকিৎসার অভিযোগ তাদেরকেই মানবিক ও সঠিক চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমে নিরসন করতে হবে। পেশার কলঙ্ক বাইরের কেউ নয়, পেশা-সংশ্লিষ্টদেরই মোচন করতে হয়। এই সত্য তারা যত তাড়াডাড়ি হৃদয়ঙ্গম করবেন, তত দ্রুতই সকলের মঙ্গল সুনিশ্চিত হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর